সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সিট ভাগাভাগিতে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের মাত্র ৩টি শরিক দল পেয়েছে ৬টি আসন। আর মহাজাটের শরিক জাতীয় পার্টির সাথে ২৬টি আসনে সমঝোতা হয়েছে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে জোটের বঞ্চিত দলগুলোর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে। এ দিকে আসন কম পেয়ে কিছুটা মনোকষ্ট নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও ছাড় দেয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় ভোটের মাঠে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে ক্ষমতাসীনদের শরিক ও মিত্র দলগুলো। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, শরিকদের ছেড়ে দেয়া আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্ত অবস্থানে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত মাঠে টিকে থাকতে পারলে এবং সুষ্ঠু ভোট হলে শরিক দলগুলোর প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্তও হতে পারে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ কুষ্টিয়া-২ ও নারায়ণঞ্জ-৫ আসন বাদ রেখে ২৯৮ আসনে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিল। গত ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে জোটের শরিক জাসদকে তিনটি, ওয়ার্কার্স পার্টিকে দুইটি ও জেপিকে একটি আসনে ছাড় দিয়ে নৌকায় উঠার সুযোগ করে দেয় আওয়ামী লীগ। ওই তিনটি দল অতীতের ধারাবাহিকতায় নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেও তাদের প্রত্যেকের আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোরালো শক্ত অবস্থানে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গত সংসদে অবিভক্ত তরিকত ফেডারেশনের দুইজন এমপি থাকলেও এবার তারা নৌকায় উঠতে পারেনি। ক্ষোভ ও অসন্তোষ নিয়ে ভোটের মাঠে দলীয় প্রতীক নিয়ে ৪২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তরিকত ফেডারেশন। এ প্রসঙ্গে দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী তার ওপর অবিচার ও অন্যায় হয়েছে বলেও জানান। তারপরও জোটনেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তিনি আস্থাশীল। তিনি বলেন, জোট নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরোধ করেছেন যে, আমি যেন নির্বাচনে থাকি। তাই আমরা নির্বাচনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ৪২টি আসনে আমাদের প্রার্থীরা ফুলের মালা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
জোটের অন্যতম শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ (মোজাফফর) দশম জাতীয় সংসদে একটি সংরক্ষিত আসনে এমপি পদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই সন্তোষ আর থাকেনি। এবারো জোটে রয়েছে উপেক্ষিত। যদিও ৫টি আসনে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে ন্যাপের প্রার্থীরা। এ প্রসঙ্গে ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো: ইসমাইল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করেছে। এখানে জোটের প্রত্যাশা বিবেচনা করা হয়নি। জোটের সাথে চূড়ান্ত আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি তিনটি দলকে ৬টি যে আসন দেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেক আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। এসব কারণে ভোটের মাঠে শুরুতেই যে উৎসাহ উদ্দীপনা বা জোয়ার ছিল এই কয়দিনে সেটার ভাটার টান শুরু হয়েছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়–য়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সরকারের অংশীদার হওয়া থেকে ছিটকে পড়েন। এবারো মূল্যায়ন করা হয়নি। গণতন্ত্রী পার্টিরও একই অবস্থা। নবম সংসদে একটি মাত্র সংরক্ষিত আসনের এমপি পদ নিয়ে খুশি থাকতে হয়েছিল তাদের। কিন্তু দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাও হারিয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া শরিকদের অন্যতম গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদ ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র জোট গঠনের পর কখনোই সরকারের অংশীদার হতে পারেনি। এবারো তারা নৌকায় চড়ে ক্ষমতার অংশীদার হতে না পারায় ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ প্রসঙ্গে বাসদের আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা জোট গঠনের শুরুতেই ছিলাম। কিন্তু আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে কখনো আমাদের মূল্যায়ন করা হয় না। এবার ভেবেছিলাম মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু আমাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তারপরও জোটের স্বার্থে আছি থাকব। তিনি বলেন, আমাদের কয়েকজন প্রার্থী আছে। তারা নির্বাচন করছে। আমরা ভোটের মাঠে কাজ করছি। এ প্রসঙ্গে জোটের আরেক শরিক গণআজাদী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এস কে সিকদার নয়া দিগন্তকে বলেন, জোটনেত্রী আমাদের বরাবরই বলে আসছিলেন, আশ্বস্ত করেছিলেন তোমার দলগতভাবে সচেষ্ট হও আগামীতে মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু সেই আশ্বাস শেষ পর্যন্ত বাস্তবে দেখতে পেলাম না। তারপরও আদর্শিক জোট হিসেবে জোটের বিজয় কামনা করি।
জোট নেতারা মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে শরিকদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার কারণে বিএনপি নেতৃত্বাধীন একটি বড় জোট নির্বাচনে অংশ না নিলেও সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা বিতর্ক তৈরি হলেও জোট-মহাজাট আকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়ে আসছে আওয়ামী লীগকে। যদি এভাবে বলা হয়- এক টাকার মধ্যে আওয়ামী লীগ যদি ৫০ পয়সা হয় তাহলে অন্য সব দল ৫০ পয়সা। আর আওয়ামী লীগ যদি ৬০ পয়সা হয় তাহলে অন্যান্য দল ৪০ পয়সা। সেক্ষেত্রে জোটের শরিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করে নির্বাচনের সমীকরণ মেলানো উচিত। তাদের মতে, শরিকদের মধ্যে কেউ কেউ না পাওয়ার ক্ষোভ রয়েছে। কিছু দল আছে যারা সরকারেও স্থান পায়নি এবং গত প্রায় ১৫ বছরে দলীয়ভাবে সরকারের তরফ থেকে তেমন সুযোগ সুবিধা মেলেনি। এখন এই সীমিত আসনের মধ্যে যদি মাত্র ৩টি শরিক দলকে ৬টি আসন দেয়া হয় সেটা সঠিক মূল্যায়নের ঘাটতি হিসেবে দেখছেন জোট নেতারা। সূত্রগুলো আরো বলছে, সরকারকে বৈধতা দেয়ার ক্ষেত্রে মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টির ভূমিকা মনে রাখার মতো। জাতীয় পার্টিকে দেয়া হয়েছে মাত্র ২৬টি আসন। সেখানে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে লড়ছেন। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে এই কৌশল অবলম্বন করা হলেও শেষমেশ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ ধরাশয়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল দলগুলো নিয়ে ২০০৪ সালে ২৩ দফা দাবিতে ১১ দলীয় জোটের সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-মশাল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-কুঁড়েঘর) এই তিনটি দল মিলে গঠিত হয় ১৪ দলীয় জোট। পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মাহবুব) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এই চারটি দল ১৪ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে যায়। তবে বাসদের একাংশ ১৪ দলীয় জোটে থেকে যায়। ফলে জোটে দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১টি। কিছু দিন পর গণফোরাম জোট ত্যাগ করলে দলের সংখ্যা হয় ১০টি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরিকত ফেডারেশন ক্ষমতাসীন জোটে অন্তর্ভুক্ত হলে দলের সংখ্যা হয় ১২টি। সম্প্রতি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (মশাল) দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে দুই অংশই জোটের সাথে কিছুদিন যুক্ত থাকলেও জাসদের (আম্বিয়া) এক অংশ সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ২০২১ সালে। ওই অংশের কেউই এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না বলে জানিয়েছেন দলটির সভাপতি শরিফ নূরুল আম্বিয়া। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আগে ১৪ দলীয় জোটের সাথে ছিলাম। এখন আর নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক থাকায় আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি না।