কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ ৮ ব্যাংক

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

গত জুনে সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি আটটি ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এর মধ্যে সাতটি হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক, যাদের ঋণ বিতরণ পরিস্থিতি একেবারেই হতাশাজনক। বিতরণের হার ৮ থেকে ৩৫ শতাংশ মাত্র। অথচ একই সময়ে দেশে কার্যরত বিদেশি খাতের আটটি ব্যাংকের সবাই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এর অর্থ, দেশীয় কিছু কিছু ব্যাংকের মধ্যেই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলোর বার্ষিক কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার অনর্জিত অংশ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের জন্য ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কমন ফান্ড (বিবিএডিসিএফ)’ নামে একটি তহবিল গঠন করেছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রার অনর্জিত অংশের সমপরিমাণ অর্থ এ তহবিলে জমা রাখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই জমাকৃত অর্থের ওপর মাত্র ২ শতাংশ হারে সুদ দেবে। অন্যদিকে

বিবিএডিসিএফে জমাকৃত অর্থ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী এবং সক্ষমতার ভিত্তিতে বরাদ্দ করা হবে। ব্যাংকগুলো বরাদ্দপ্রাপ্তির সর্বোচ্চ ১৮ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে ২ শতাংশ হারে সুদসহ আসল পরিশোধ করবে।

কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে প্রতিবছর কৃষি ও পল্লীঋণ নামে নীতিমালা প্রণয়ন করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিমালার আওতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য পৃথক পৃথক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এ লক্ষ্য বাস্তবায়নেও তদারকি করা হয়। চলতি অর্থবছরের কৃষি ও পল্লীঋণ নীতিমালা আগামী রবিবার ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, গত অর্থবছরের তুলনায় এই বছর কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জন্য এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সব ব্যাংক মিলে ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়। এটি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১০৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময় ওই ৮টি বাদে অন্য সব ব্যাংকই লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি ঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে পুরো অর্থবছরে সার্বিকভাবে কৃষিঋণ বিতরণের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্র অতিক্রম হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ বিতরণে এগিয়ে রয়েছে। গত অর্থবছরে সরকারি খাতের আট ব্যাংকের কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্র ছিল ১১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১৩ হাজার ১০৪ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোকে দেওয়া নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১১২ দশমিক ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে গত অর্থবছরে এ খাতে বেসরকারি ও বিদেশি ৫৪টি ব্যাংকের ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১০২ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়ে অধিকাংশ ব্যাংকই শতভাগের বেশি ঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ৮টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের একটি ও বেসরকারি খাতের ৭টি ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো বেসিক ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও মধুমতি ব্যাংক।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি বিতরণ করতে পেরেছে ৪৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বা ৯৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২১ কোটি টাকা, বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র ১৭৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এটি ব্যাংকটির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩৩ দশমিক ৮১ শতাংশ বিতরণ করতে পেরেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটি বিতরণ করেছে ৭৩২ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৭৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। চতুর্থ প্রজন্মের গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল ২২৬ কোটি। সেখানে তারা বিতরণ করেছে ৭৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।

চতুর্থ প্রজন্মের আরও দুটি ব্যাংকেরও কৃষিঋণ বিতরণ পরিস্থিতি ভালো হয়নি। এর একটি মধুমতি ব্যাংকের ৯০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও দিতে পেরেছে মাত্র ৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এটি নির্ধারিত লক্ষ্য মাত্রার ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অপরটি হচ্ছে ইউনিয়ন ব্যাংক। এর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৯২ কোটি। সেখানে তারা ৫০ কোটি ৮৬ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ ছাড়া গত অর্থবছরে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬১২ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি বিতরণ করেছে ১৭১ কোটি, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ২৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকের অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় অন্য ঋণের চেয়ে কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার তুলনামূলক কম। গত অর্থবছরে সুদহার নির্ধারণ করা ছিল সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ। তবে সব কৃষক এই সুদহারে ঋণ পাননি। কারণ ব্যাংকগুলোর এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) নির্ভরতার কারণে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের ঋণ পেতে গুনতে হয়েছে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ। এ কারণে কম সুদে কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছাতে এবার ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর এ জন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এতদিন ছিল ৩০ শতাংশ। এবার মোট কৃষিঋণের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল খাতে, ১৩ শতাংশ মৎস্য খাতে এবং ১৫ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের অন্যান্য ঋণের সঙ্গে কৃষিঋণের সুদহারের সীমাও তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে কৃষিঋণের সুদহারও নির্ধারিত হবে ‘সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট’ বা স্মার্ট পদ্ধতিতে। নতুন এ নিয়মে ছয় মাসের (১৮২ দিন) ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে রেফারেন্স রেট। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ২ শতাংশ যোগ করে কৃষিঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। এ নিয়মে জুলাই থেকে কৃষিঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। এতে ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি কৃষিঋণ বিতরণ করলেও সুদহার ১ শতাংশের বেশি বাড়বে। তারপরও এনজিও-নির্ভরতায় বিতরণ করা ঋণের সুদের তুলনায় এটি অনেক কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *