ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না চামড়াশিল্প

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

বছরের পর বছর খাদের কিনারেই পড়ে আছে দেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় খাত চামড়াশিল্প। নানা সংকটের কারণে কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না সম্ভাবনাময় এ শিল্প। বিশেষ করে কোভিড মহামারীর প্রভাবে এ শিল্প চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন করে যুক্ত হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রপ্তানিতে নামে ধস। নতুন সংকট তৈরি হয়েছে লবণের দাম বাড়ায়। বছরের ব্যবধানে দেশে খোলা লবণের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে আসছে কোরবানি ঈদে পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কাঁচাচামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিলমালিকরা কারসাজি করে লবণের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এবার চামড়া সংগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে কার্যকর হয়নি কাক্সিক্ষত প্রধান বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি)। সব কিছু মিলিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে চামড়াশিল্প। এ খাতের ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। সময়মতো ঋণ শোধ করতে না পারায় পুনরায় ব্যাংকঋণ পাচ্ছেন না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ শিল্পে শ্রমিকের সুরক্ষা, প্রশিক্ষণ, আবাসন, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এর ফলে মিলছে না বিদেশি সনদ।

আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া কেনা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন ট্যানারির মালিকরা। তারা বলছেন, চামড়া কেনার মতো টাকা তাদের হাতে নেই; আবার ব্যাংকঋণও মিলছে না।

হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে সরকার ‘রেড জোন’ ঘোষণা করলেও মালিকরা সেই জমি না পারছেন বিক্রি করতে, না পারছেন বন্ধক রেখে ঋণ নিতে। আবার সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরীতে এখনো প্রস্তুত হয়নি কঠিন বর্জ্য শোধনাগার। পরিবেশবান্ধব ট্যানারিশিল্প না হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্রও দিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কঠিন সময় পার করছেন ট্যানারির মালিকরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাভারে চালু থাকা ১২৩টি ট্যানারির বেশির ভাগই চীনে চামড়া রপ্তানি করে। রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেও।

ট্যানারির মালিকরা বলছেন, চামড়া রপ্তানি না হওয়ায় ট্যানারিগুলো আর্থিক সংকটে পড়ছে। এতে ঋণের সুদ বাড়ছে। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে বেশির ভাগ ট্যানারি খেলাপি হবে। এ সংকট উত্তরণে সরকারের সহায়তা দরকার।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-মে) ১১ মাসে চামড়া রপ্তানিতে ধস নেমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, এই সময়ে ১১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকার চামড়া রপ্তানি হয়, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ১১ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয় ১৩৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকার চামড়া। চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ রপ্তানি কম হয়েছে।

উদ্যোক্তরা বলছেন, পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদনের লক্ষ্যে শিল্প স্থানান্তর করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা অপরিকল্পিতভাবেই হয়েছে। এ কারণে ইউরোপের বাজার হারাতে হয়েছে। এর পর চামড়া খাতে রপ্তানির বড় বাজার ছিল চীন। একক দেশ হিসেবে চীনে ৬৫ শতাংশ চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি হয়। এ সময়ে যে পরিমাণ ঋণপত্র, রপ্তানি আদেশ ও পণ্য সরবরাহ হওয়ার কথা, মহামারীর কারণে তা হয়নি। এতে ব্যবসায়ীরা নতুন করে সংকটে পড়েছেন। ইতোমধ্যে ১০ থেকে ১৫টি মাঝারি ট্যানারি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বেশির ভাগ ট্যানারি চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শহীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, চামড়াশিল্প এখনো কঠিন সময় পার করছে। উদ্যোক্তারা যেমন সমস্যায় জর্জরিত, তেমনি রপ্তানিতেও সমস্যা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো না। লোকসানের পর লোকসান দিয়ে উদ্যোক্তারা এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এভাবে আর কত লোকসান দেবেনÑ একটা সময় তারা হাল ছেড়ে দেবেন।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দিলজাহান ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘বর্তমানে চামড়াশিল্প মহাসংকটে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের হাত খালি; ঋণে জর্জরিত; ব্যাংকঋণ দিচ্ছে না।’

২০১৭ সালের আগস্টে হাজারীবাগের ২২৫টি ট্যানারি কারখানা একদিনে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রভাবে নামিদামি বিদেশি ক্রেতাদের অধিকাংশই চলে যান। মূলত এর পর থেকেই এই শিল্পের সংকট তীব্র হয়। সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে আসার পর এই শিল্পের রপ্তানি বাড়ার কথা থাকলেও কমেছে। কারণ সাভারের হেমায়েতপুরে যেখানে এই শিল্প স্থানান্তর করা হয়েছে, সেখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) তখনো প্রস্তুত করা হয়নি। ডাম্পিং স্টেশন ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সব কিছুই অসম্পূর্ণ ছিল।

চামড়া খাতকে একসময় সম্ভাবনাময় মনে করা হলেও এটি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে। দ্বিতীয় শীর্ষ এই রপ্তানি খাত এখন চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে।

পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী সাভারে স্থানান্তরে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষের কথা ছিল। কিন্তু ১৯ বছর পার হয়ে গেলেও এই শিল্পনগরী পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠেনি।

প্রকল্প শেষ না হলেও ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত হাজারীবাগের চামড়া কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেন। ফলে সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে কিছু চামড়া কারখানার বৈশ্বিক প্ল্যাটফরম ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের’ (এলডব্লিউজি) সনদ ছিল। এ সনদের সুবাদে তারা জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকায় চামড়া রপ্তানি করতে পারত। হাজারীবাগে কারখানা বন্ধ হওয়ায় সেই সনদ ও বায়ার (বিদেশি ক্রেতা) হারায় কারখানাগুলো। এত দীর্ঘসময়েও সাভারের চামড়া শিল্পনগরী পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত না হওয়ায় এখনো এলডব্লিউজির সনদ ফিরে পায়নি কারখানাগুলো। একই সঙ্গে নতুন বাজার সৃষ্টি হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *