ছায়া-ঢাকা নগরীতে মরুর উত্তাপ

Slider সারাদেশ

রাজধানী ঢাকা ছিল ছায়া-ঢাকা, পাখি-ডাকা এক নগরী। ছিল খোলা প্রান্তর, মাঠ-ঘাট, উদ্যান আর অজস্র বৃক্ষরাজি। সময় গড়িয়েছে, এ নগরীর বুকজুড়ে ভবনের পর ভবন বসেছে, প্রকল্পের পর প্রকল্প এসেছে- আধুনিকায়ন আর উন্নয়নের করাতে কাটা পড়েছে বৃক্ষরাজি। সবুজের সেই সমারোহ বিলীন হয়ে ক্রমেই ধূসর হয়ে যাচ্ছে এ শহর। সবুজভূমির ঢাকা সময়ের বিবর্তনে হয়ে যাচ্ছে ধূসর মরুভূমি। ফলে এ শহরের তাপমাত্রাও দিন দিন মরুভূমির মতোই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। গত শনিবার ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পর দিন অর্থাৎ রবিবার তা বেড়ে হয় ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ শহর থেকে সবুজ হারিয়ে যাওয়ায় আগুন ঝরাচ্ছে তাপমাত্রা।

ঢাকা শহর থেকে প্রতিবছর গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। আর আদর্শ একটি শহরে মোট আয়তনের অন্তত ২০ শতাংশ সবুজ থাকার কথা। উদ্বেগজনক হলেও সত্যি- কোটি মানুষ অধ্যুষিত ঢাকায়

বর্তমানে রয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) ২০২০ সালের জরিপে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় সবুজ ও খোলা জায়গার পরিমাণ ছিল ২১ শতাংশ। ক্রমান্বয়ে তা কমতে কমতে ২০২০ সালে ঢাকার সবুজ ও খেলার মাঠের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ। বর্তমানে সেটি সাড়ে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে ঢাকা থেকে সবুজ বিলীন হয়ে গেছে। এ মহানগরীতে এখন সবুজ বলতে রয়েছে গুটিকয় উদ্যান ও পার্ক। এগুলোর অধিকাংশেরই আবার নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণ। দেখে মনে হয় উচ্ছিষ্ট।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকার সবুজ এলাকা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০২০ সালের পর প্রচুর উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেই প্রকল্পগুলো সবুজকে ধ্বংস করেই করা হচ্ছে। আগে যেখানে ফাঁকা জায়গা ছিল, গাছপালা ছিল;, সেখানে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে বহুতল ভবন হয়েছে। এ অবস্থা ঢাকার জন্য অ্যালার্মিং।

ওসামানী উদ্যানে একসময় প্রচুর গাছ ছিল। সেখানে গত কয়েক বছরে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অসংখ্যা গাছ কেটে পাকা স্থাপনা করা হয়েছে। উদ্যানটিতে অনেক দিন ধরেই জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। একইভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্কের উন্নয়ন করতে গিয়েও কাটা হয়েছে গাছ। এভাবে বৃক্ষের পর বৃক্ষ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছিল- একটি গাছ কাটলে তিনটি গাছ লাগাতে হবে। সেই ঘোষণার প্রতিফলন বাস্তবে নেই। গাছ কাটা হলেও নতুন করে রোপণ করা হচ্ছে না।

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার আনোয়ার পার্কে এখন মেট্রোরেলের মালামাল রাখার স্থান করা হয়েছে। একইভাবে আজিমপুরের সরকারি কলোনিগুলোর ফাঁকে এক সময় প্রচুর গাছপালা ছিল, সেগুলো কেটে বড় বড় অট্টালিকা হয়েছে। কল্যাণপুরে সরকারি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করতে গিয়েও কাটা হয়েছে অসংখ্য গাছ।

অন্যদিকে সিটি করপোরেশন এলাকার রাস্তার দুই পাশে এবং রাস্তার মিডিয়ানে যে গাছ ছিল, সেগুলোও বিলীন হয়ে গেছে। উন্নয়নের নামে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তার মিডিয়ানে যে ছোট ছোট গাছ ছিল, সেগুলো এখন আর নেই। তা ছাড়া ধানমন্ডির স্টার কাবাব থেকে শুরু করে ৩/এ আওয়ামী লীগ অফিস পর্যন্ত প্রধান সড়কে মিডিয়ানে ছোট-বড় অনেক গাছ ছিল, সেগুলো কেটে মরুময় করে ফেলেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। একইভাবে শ্যামলী এলাকার রাস্তার মিডিয়ানের গাছ কেটে নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া মাঠ-পার্ক উন্নয়নের নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে সেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। আবার ওসমানী উদ্যানে দীর্ঘ দিন চলছে উন্নয়ন চর্চা সেখানেও গাছ কেটে স্থাপনা করা হচ্ছে। উদ্যানের ভেতর ফুড কোর্ট, কফি হাউস নির্মাণ করার পরিকল্পনায় ঢাকা থেকে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে সবুজায়ন হারাচ্ছে তাতে ঢাকার তাপ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর আগারগাঁও থেকে শ্যামলী শিশুমেলা পর্যন্ত রাস্তার পাশে যে গাছ ছিল, সেগুলো কেটে রাস্তা প্রশস্তকরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি সড়কের গাছ কেটে রাস্তা প্রশস্তকরণ এবং ফুটপাত মেরামত করা হয়েছে। তাতে অনেক গাছ কাটা পড়েছে। অন্যদিকে বিমানবন্দর থেকে কুড়িল বিশ^রোড পর্যন্ত রাস্তায় একটি বেসরকারি সংস্থাকে গাছ লাগানোর দায়িত্ব দিয়ে সেখানে দেশীয় গাছের পরিবর্তে বিদেশি বনশাই গাছ লাগানো হলেও সেগুলো এখন বিলীন হয়ে গেছে। ফলে সবুজ এলাকা হারিয়েছে ঢাকা।

ঢাকার সবুজায়নে ভূমিকা রাখে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। এসব সংস্থার মাঠ-পার্ক রয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেকের খোলা জায়গা রয়েছে। সেসব খোলা জায়গা এবং সবুজায়ন ধ্বংস করে বহুতল ভবন করা হয়েছে।

গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে কোথাও গাছ লাগানো হয়নি। উদ্যান বা পার্কে যে জায়গায় গাছ মারা গেছে, সেখানেই শুধু গাছ লাগানো হয়েছে। তবে ঠিক কতগুলো গাছ গত ৫ বছরে লাগিয়েছে, তার পরিসংখ্যান নেই এই সংস্থার কাছে।

পরিবেশের প্রতি নজর নেই সিটি করপোরেশনেরও। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২০২১-২২ অর্থবছরে উদ্যান ও খেলার মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল মাত্র ৫ হাজার টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাখা হয়েছে মাত্র ২০ হাজার টাকা। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন খালের উন্নয়ন, সীমানা নির্ধারণ ও বৃক্ষায়ন খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১৪ কোটি, যদিও সংশোধিত বাজেটে সেটা দাঁড়ায় মাত্র ৬ কোটিতে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০ কোটি টাকা। তবে দুই সিটি করপোরেশনের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুধু বিদ্যমান পার্ক এবং খেলার মাঠের চারপাশেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো গাছ লাগানো হয়নি।

সিটি করপোরেশন রাস্তার দুই পাশে বা মিডিয়ানে যে গাছ লাগানোর কর্মসূচি নিয়ে থাকে, সেখানেও পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, একটা রাস্তায় বা মিডিয়ানে কোন গাছ লাগালে সেটি বাঁচবে, আর কোন গাছ লাগালে পরবর্তী সময়ে ঝরে উপড়ে পড়বে- এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা ছাড়াই যে যার ইচ্ছেমতো গাছ লাগায়। এতে কিছু দিন পর আবার সেই গাছ কেটে ফেলতে হয়। আবার কিছু গাছ অঙ্কুরেই মারা যায়।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে পরিবেশবিদ থাকলেও নেই উদ্ভিদবিদের পদ। যে কারণে কোন রাস্তায় কোন গাছ লাগাতে হবে, তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ মো. খায়রুল বাকের আমাদের সময়কে বলেন, আমরা অনেক মাঠ প্রস্তুত করেছি। যেখানে আগে অবৈধ দখলে ছিল, সেগুলো উদ্ধার করে খেলার মাঠ করেছি এবং সেই মাঠের চারদিকে গাছ লাগানো হয়েছে। রাস্তার মিডিয়ানে এবং দুই পাশে আগে অপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হয়েছে। যে কারণে ঝড়-বৃষ্টি হলেই গাছ উপড়ে পড়ত। আমরা এখন ফুল গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগাচ্ছি। যেখানে যে গাছ টিকবে, সেগুলোই লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।

গত ২০ মার্চ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের আয়োজনে ‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক সেমিনারে কিছু তথ্যচিত্র উপস্থাপন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জসিম উদ্দীন বলেন, শুধু সবুজ থাকলেই চলবে না, সঠিক গাছটি লাগাতে হবে। এর জন্য বটম আপ সমন্বিত নীতি করে দরকার অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের দেশীয় প্রজাতির অনেক গাছ বিপন্ন। এসব রক্ষা করতে হবে জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়োজনেই। তিনি বলেন, থাইল্যান্ডের ওয়াক্কাচুয়া গাছ থেকে দেশি ছাতিম গাছ অনেক ভালো।

ঢাকার সবুজায়ন নিয়ে মোহাম্মদ এন খান বলেন, ইউএসএইড বাংলাদেশে ১৯৯৮ সাল থেকে কাজ করছে। তারা মূলত সংরক্ষিত বন নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো শহরের সবুজ নিয়ে কাজ করেছে। ঢাকায় ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বার্ষিক ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সবুজ এলাকা হারিয়েছে। সুতরাং জাতীয় স্থানীয় পরিকল্পনা ও নীতিতে এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে।

২০১১ সালে টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঢাকায় বায়ুর আরাম ও ধরন’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর ভবনগুলো এমনভাবে তৈরি হচ্ছে যে সেখানে আলো-বাতাস কম প্রবেশ করছে। নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর বেশির ভাগ ভবনের প্রতিটি ফ্লোর বা তলার মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ছিল ১১ থেকে ১৩ ফুট। ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিটি তলার উচ্চতা কমিয়ে সাড়ে ৯ ফুট করা হচ্ছে। আগের ভবনগুলোর ছাদে ও জানালায় কার্নিশ দেওয়ার চল ছিল। এখনকার ভবনে তা উঠেই গেছে। ফলে বাইরের তাপ প্রতিটি ভবনকে একেকটি অগ্নিচুল্লিতে পরিণত করেছে। ওই গবেষণাতেই দেখা গেছে, ফ্ল্যাট-বাড়িগুলোর রান্নাঘর ও টয়লেট এমনভাবে নির্মিত হচ্ছে যেন সেখানকার তাপ বাইরে বের না হয়ে ঘরের মধ্যেই আটকে থাকছে। ঘরে আলো না থাকায় সারা দিন বাতি জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে। ঘরের তাপ কমাতে অনেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপন করছেন। এতে ঘর ঠা-া থাকছে ঠিকই, কিন্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে বের হওয়া তাপের কারণে ভবনের বাইরের তাপমাত্রা বাড়ছে, যা ভবনটিকেই আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে রাজধানীতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের কারণে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *