ছড়িয়ে পড়ছে বন্যা

Slider সারাদেশ


প্রায় সব নদী-নদীর পানি বাড়তে থাকায় দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে জেলাগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় পানি কমার সম্ভাবনা নেই। পানি বাড়বে জামালপুর ও টাঙ্গাইলেও। অন্যদিকে সিলেট অঞ্চলে কিছু জায়গায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও নতুন করে প্লাবিত হয়েছে অনেক এলাকা।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত সোমবার রংপুর সীমান্তের ওপারে শিলিগুড়িতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। এতে ব্যাপক পানি বেড়েছে মহানন্দা নদীতে। মহানন্দার আশপাশের অনেক এলাকা এরই মধ্যে ডুবে গেছে।

বাংলাদেশের বন্যা পুনর্বাসন ও সতর্কতা কেন্দ্র বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকাসহ দেশের সব নদীতে পানি বাড়তে পারে। এ সময়ে আসাম, হিমালয়সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে মেঘালয়ে বৃষ্টিপাত কমেছে এবং আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বাড়ার আশঙ্কা নেই। দৈনিক আমাদের সময়ের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের চারটি পয়েন্টেই বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। একই অবস্থা যমুনা নদীর পাঁচটি পয়েন্টে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধার ধরলা ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে রয়েছে।

এ ছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর চলে যেতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আশঙ্কা করা হয়েছে। অন্যদিকে পদ্মা নদীর সুরেশ্বর পয়েন্টের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও হবিগঞ্জে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সুরমা-কুশিয়ারার পানি গতকালও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ভারতের ত্রিপুরায় ভারী বর্ষণে কুমিল্লার গোমতী নদীতেও পানি বাড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে নদীর আশপাশের অনেক এলাকা ডুবে গেছে। মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে ফেনীতেও তলিয়েছে নতুন এলাকা।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, সব নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। গতকাল বিকাল ৩টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তা ও করতোয়ায় বিপদসীমার নিচে থাকলেও পানি বাড়ছে।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, তিস্তা ও ধরলার পানি বেড়ে জেলার ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নদীগর্ভে বাড়িঘর হারিয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবার। গতকাল সকাল ৯টায় হাতীবান্ধার দোয়ানী পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই ছিল।

ফুলছড়ি (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, বন্যার কারণে ৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করেছে উপজেলা শিক্ষা অফিস। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে প্রতিদিনই ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়ছে। গতকাল বিকালে ফুলছড়ি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, তিস্তা নদীর পানি গতকালও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদ দৌলা জানান, এ জেলায় দুদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত নেই। কিন্তু ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের জলকপাট খুলে দেওয়ায় সেখানকার পানি ধেয়ে আসছে তিস্তায়। ফলে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে তিস্তার পানি।

নিজস্ব প্রতিবেদক (কুড়িগ্রাম) জানান, জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি গতকালও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর পানি অনেক জায়গায় আটকে যাওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসিদের। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবারের সংকট তৈরি হয়েছে। গবাদিপশুর খাবারও পাওয়া যাচ্ছে না।

গতকাল কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্রে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৫৫ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক (বগুড়া) জানান, যমুনা নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে নদী তীরবর্তী আরও কিছু এলাকা। তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি এবং ফসলি জমি। দেখা দিয়েছে খাবার পানি ও শুকনো খাবারের তীব্র সংকট।

উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বন্যার পানিতে ডুবে আকাশ (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে সাঁতার কাটতে নিয়ে বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় যে। আকাশ উল্লাপাড়া উপজেলার পূর্ণিমাগাঁতী ইউনিয়নের পশ্চিম কৃষ্টপুর গ্রামের মো. শরিফ উদ্দিনের ছেলে।

ইসলামপুর (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, বন্যার পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। গতকাল বিকালে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি ৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে প্লাবিত হয় নতুন নতুন এলাকা। গতকাল পর্যন্ত চিনাডুলি, বেলগাছা, কুলকান্দি, নোয়ারপাড়া, সাপধরী ও পলবান্ধা ইউনিয়নের ৩৮টি গ্রামের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, যমুনা নদীতে ২৪ ঘণ্টায় আরও বেড়েছে। এতে গোবিন্দাসী, গাবসারা, নিকরাইল ও অর্জুনা ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।

মৌলভীবাজার ও কুলাউড়া প্রতিনিধি জানান, চার উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নামছে না পানি, মানুষজন ফিরতে পারছে না নিজ ভিটায়। এদিকে বন্যাকবলতি এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণের জন্য প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে। রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ি ও বড়লেখা উপজলোর ২৫টি ইউনিয়নের দুই শতাধকি গ্রামে লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নবীগঞ্জ উপজেলার ১১টি, লাখাই উপজেলায় ৬টি ও বানিয়াচঙ্গ উপজেলার ১৫টি ইউনিয় বন্যার কবলে পড়েছে। এ ছাড়া বন্যা হয়েছে আজমিরিগঞ্জ পৌর এলাকাও। হবিগঞ্জ সদরে ৬টি ও বাহুবলে ১টি ইউনিয়ন এখন বন্যার কবলে। জেলায় ১৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

মাধবপুর (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সেখানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ফসলের মাঠসহ তলিয়ে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট। উপজেলার জগদীশপুর, বুল্লা, আন্দিউড়া ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

বিয়ানীবাজার (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, সেখানে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ার কারণে উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বেশ কয়েকটি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত উপজেলার ২৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে ২৫০টি পরিবার।

জকিগঞ্জ (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। উপজেলার সুরমা-কুশিয়ারা নদীর প্রায় ৩৮টি ‘ডাইক’ দিয়ে বানের পানি লোকালয়ে এসে ৯টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে জকিগঞ্জ-সিলেট সড়কের কিছু অংশ। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে ১৫৬টি পরিবার।

দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, গোমতী নদীর বিপদসীমা সাড়ে ৮ সেন্টিমিটার। গতকাল বিকালে সেখানে সাড়ে ৭ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের বেড়িবাঁধসংলগ্ন রঘুরামপুর ও গঙ্গানগর। ওই এলাকার প্রায় ১২০০ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কলমাকান্দার উদ্ধাখালী, দুর্গাপুরের সোমেশ^রী, খালিয়াজুরীর ধনুসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমছে। সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া উদ্ধাখালী, কংশ, ধনু নদীর পানিও দুদিন ধরে কমছে। জেলার খালিয়াজুরীতে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। প্রতিটি উপজেলায় সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাবারের।

রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, পদ্মার তীব্র স্রোতের কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফেরি চলাচল ধীরগতির কারণে যানবাহনের পারাপার কমে গেছে।

গোয়ালন্দ উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক ইদ্রিস আলী বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি দৌলতদিয়া পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে নদীতে প্রচণ্ড স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *