কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর

Slider জাতীয়

 

image_209420.kamaruzzaman12
Decrease font Enlarge font
ঢাকা: একাত্তরের আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার (১১ এপ্রিল) রাত দশটা ১ মিনিটে এ ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশের জন্য আরও একটি নতুন ইতিহাস রচিত হলো।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা-গণহত্যা, ব্যাপক নিধনযজ্ঞ, দেশান্তর, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন করে হত্যা, ষড়যন্ত্রের মতো বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে। এর মধ্যে শেরপুরের সোহাগপুরে গণহত্যা-ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির আদেশ পান তিনি। আরও কয়েকটি অপরাধে আদালত যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডাদেশ দিলেও সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হওয়ায় সেসব সাজা ভোগের প্রয়োজন পড়েনি।

শনিবার রাতেই কামারুজ্জামানের মরদেহ তার পরিবার পরিজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদীপাড়া গ্রামের বাড়িতে তার নামাজে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হবে। কারাগারের অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তায় সেখানে পাঠানো হবে মরদেহ।

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার দ্বিতীয় ফাঁসির রায় কার্যকর, যার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হলো একাত্তরে আলবদর বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব কমান্ড দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর।

এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল জামায়াতেরই অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার। ‘মিরপুরের কসাই’ আলবদর কমান্ডার কাদের মোল্লাকেও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল রাত দশটা এক মিনিটেই।

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল জুড়ে নারকীয় সব যুদ্ধাপরাধের হোতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির লিভারে টান দিয়ে ঐতিহাসিক এ দায়িত্ব পালন করেন প্রধান জল্লাদ রানা। অন্য তিনজন জল্লাদ ছিলেন তার সহযোগী। জল্লাদ রানা এর আগে আরেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় সহকারী জল্লাদের ভূমিকা পালন করেছেন।

এর আগে দুপুরে কারাগারে পৌঁছায় মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় ও সশস্ত্র বিরোধিতাকারী কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে সরকারের নির্বাহী আদেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সে আদেশও তাকে পড়ে শোনানো হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।

দুপুরেই কামারুজ্জামানের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে শেষবারের মতো তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। বিকেল চারটার পরপরই ২১ জন স্বজন কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শেষ সাক্ষাৎ করেন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুর জেলার সোহাগপুর গ্রামে ১৬৪ জনকে হত্যা ও নারী নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হলে গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলে গত ৫ মার্চ তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন কামারুজ্জামান। ৬ এপ্রিল এ আবেদনও খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। গত বুধবার (৮ এপ্রিল) রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পাঠানো হয় কারাগারে।

এরপর তার মৃত্যুদণ্ড রোধে একটাই পথ ছিলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমা। ফাঁসির রায় পড়ে শোনানোর পর তাই তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তিনি দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি-না। তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিতে ‘যৌক্তিক সময়’ চেয়ে চারদিন কাটিয়ে দেন এই জামায়াত নেতা। পরে শুক্রবার (১০ এপ্রিল) তার কাছে আবারও শেষ সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হয়। এ সময়ই সিদ্ধান্ত জানতে যাওয়া দু’জন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারা কর্তৃপক্ষ  নিশ্চিত হয়, কামারুজ্জামান ক্ষমা চাইছেন না।

প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরই কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় কারাগার।

এভাবেই আইনগত সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই কার্যকর হলো তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ।

যেভাবে ফাঁসি কার্যকর করা হয়
ফাঁসি দেওয়ার আগে ৮নং কনডেম সেলে গিয়ে কামারুজ্জামানকে গোসল করিয়ে কারাগারের মাওলানার মাধ্যমে তওবা পড়িয়ে নেন কারা কর্তৃপক্ষ। এ সময় তার কাছ থেকে তার শেষ কোনো কথা থাকলে তাও শুনে নেন কারা কর্মকর্তারা।

ধর্মীয় রীতি অনুসারে তওবা পড়ান কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন। এর আগেই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন কারা চিকিৎসক আহসান হাবীব।

সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী রাতেই তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে বলে কামারুজ্জামানকে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, এটাই আপনার শেষ রাত। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে।

মাওলানা মনির হোসেন তাকে বলেন, আপনার কৃতকর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। আপনি একজন মুসলমান ব্যক্তি। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃতকর্মের জন্য তওবা করেন।

এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট দশেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন। তারা কামারুজ্জামানকে নিয়ে যান ফাঁসির মঞ্চে। আগে থেকেই মঞ্চের পাশে রাখা ছিল মরদেহ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স।

ফাঁসির মঞ্চে নেওয়ার পর তার মাথায় পরানো হয় একটি কালো রংয়ের টুপি। এই টুপিটিকে বলা হয় ‘যমটুপি’।

ফাঁসির মঞ্চে তোলার পর কামারুজ্জামানের দুই হাত পিছন দিকে বাধা হয়। এ সময় ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন কারা কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট। ফাঁসির মঞ্চে প্রস্তুত ছিলেন জল্লাদও। মঞ্চে তোলার পর তার দুই পাও বাধা হয়। পরানো হয় ফাঁসির দড়ি।

কারা কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল একটি রুমাল। রুমালটি হাত থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই  জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেন। লিভারটি টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁসির মঞ্চের নিচে চলে যান কামারুজ্জামান। এ সময় তিনি মাটি থেকে ৪-৫ ফুট শূন্যে ঝুলে থাকেন। এতে মুহূর্তের মধ্যেই তার ঘাড়ের হাড় ভেঙ্গে মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়।

ফাঁসি কার্যকর করার সময় ফাঁসির মঞ্চে ও কারাগারের ভেতরে ছিলেন আইজি (প্রিজন) সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কর্নেল কবির, ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. ফরমান আলী, জেলার নেসার আলমসহ অন্য কারা কর্মকর্তারা।

ছিলেন ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন, ঢাকার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা, কারাগারের চিকিৎসক আহসান হাবিব, ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং ডিএমপি কমিশনারের প্রতিনিধি ডিসি-ডিবি (নর্থ) শেখ নাজমুল আলম।

ডিএমপি’র জয়েন্ট কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শেখ মারুফ হাসান, ডিসি-ডিবি (সাউথ) কৃষ্ণপদ রায়, র‌্যাবের ইন্টিলিজেন্স প্রধান আবুল কালাম আজাদ এবং ডিবি’র বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সানোয়ার হোসেনও ছিলেন কারাগারে।

নিরাপত্তার চাদরে কারাগার
কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সন্ধ্যায় জেলখানার মূল ফটক ঘিরে ফেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চারদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিভিন্ন বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়।

পুরো কারাফটক জুড়ে ছিলেন ২২ প্লাটুনের মতো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। পুলিশের পাশাপাশি ছিলেন র‌্যাব এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। বন্ধ করে দেওয়া হয় কারাগারের

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *