হারাচ্ছে জীবন ডুবছে স্বপ্ন

Slider শিক্ষা


‘চোরাবালির মতো ডিপ্রেশন বেড়েই যাচ্ছে, মুক্তির পথ নেই, গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন, মেনে নিতে পারছি না।’- এমন সুইসাইড নোট লেখে বাবার ডায়েরিতে রেখে গেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া তাবাসসুম। গলায় ফাঁস দিয়ে গত ১০ মে আত্মহত্যা করেন মেধাবী এ ছাত্রী। কেবল সাদিয়াই নন, গত ২০ দিনে সাত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহননের তথ্য মিলেছে।

তাদের সুইসাইড নোট ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলা জানা যায়, সম্পর্কের টানাপড়েন, আর্থিক অনটন, পারিবারিক ও মানসিক সংকট থেকেই তারা সেই চোরাবালির পথে পা বাড়িয়েছেন।

সমাজ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করতে হবে। যখনই বোঝা যাবে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে, তখন তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে প্রাণ খুলে। মানসিক টানাপড়েন থাকা ব্যক্তিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু এখন সময়ের দাবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সামনে নিরাপদ কোনো ভবিষ্যৎ আমরা দিতে পারছি না। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জীবনবোধের উন্নতির জন্য কাজ নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে এসে তারা (শিক্ষার্থী) হতাশায় ডুবে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘মন খুলে কথা বলার মানুষের অভাব সৃষ্টি হচ্ছে দিন দিন। এ ক্ষেত্রে পরিবার ও বন্ধুদের সম্পর্ক উন্নতি করতে হবে। সমস্যা আসবেই তার সমাধানও আছে- এ বিষয়টি তাদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটি বিভাগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের ক্যারিয়ার ও জীবন নিয়ে কাউন্সিলিংয়েরও ব্যবস্থা করতে হবে।’

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) হিসাব করলেই একটি দেশের উন্নতি হয় না। নাগরিকদের সুখ ও স্বস্তি নিয়েও রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। ভুটানে মিনিস্ট্রি অব হ্যাপিনেস রয়েছে। তারা অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি নাগরিকের সুখ নিয়েও কাজ করে। ফলে ভুটানে আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধও কম।’

এদিকে শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে এসে ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তারা। পরিবার থেকেও চাপ বাড়ে তখন। নিজেদের খরচ চালানোর যে কাজের ব্যবস্থা ছিল সেগুলোও ভেঙে যায়। করোনার আগে শিক্ষার্থীদের যে রুটিন ছিল সেটাও ভেঙে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতেও দেরি হচ্ছে। সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেছে। সে সঙ্গে লেখাপড়ার চাপ, পরিবারের চাহিদা, সেই সঙ্গে প্রিয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের চাপ সামলাতে পারেন না অনেকেই। তাদেরই কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

সুইসাইড নোট লিখে গত বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন ঢাবি শিক্ষার্থী জায়না হাবিব প্রাপ্তি। চিরকুটে তিনি লিখে গেছেন- ‘আমার জীবন একটা ব্যর্থ জীবন। না পারলাম মা-বাবাকে খুশি করতে, না পারলাম অন্য কাউকে খুশি করতে। আমি গেলে কিছু আসবে যাবে না জানি।’

প্রাপ্তির মতোই হতাশা আর ব্যর্থতার চোরাবালিতে ডুবে হারিয়ে গেছেন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবিদ বিন আজাদ, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবিএম ত্বকী তানভীর, ইউএপির (ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক) ইমাম হোসেন মিশু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অমিত কুমার বিশ্বাস ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অঙ্গন বিশ্বাস। এ ছাড়া সদ্য ঢাবি থেকে পাস করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান ঢাকার পান্থপথের বাসায় আত্মহত্যা করেন। সুইসাইড নোটে তিনিও লিখে যান হতাশার কথা।

আত্মহত্যাকারীদের স্বজনরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে কিংবা মেয়েটিকে ঘিরেই স্বপ্ন বুনেন পরিবারের সদস্যরা। সেই মানুষটি যখন নিজেকেই নিজে হত্যা করে তখন পুরো পরিবারের জন্য তৈরি হয় ভয়াবহ মানবিক সংকট। যে ক্ষত সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সহ্য করতে হয় আশপাশের লোকজনের লাঞ্ছনা। শুনতে হয় নানা কটুকথা। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। তার আগের বছর সেই সংখ্যাটা ছিল ৭৯ জন, যাদের ৬১ শতাংশেরও বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের মধ্যেই বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, করোনায় অনেকের টিউশনি চলে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে আয়-রোজগার। বাধ্য হয়ে তাই অনেককে দীর্ঘ সময় বাড়িতে থাকতে হয়েছে। তারা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে আগের স্বাভাবিক রুটিনে ফিরতে পারছেন না। পূরণ করতে পারছেন না পরিবারের প্রত্যাশাও। সামাজিক জীবন বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি অনেকের সম্পর্কও ভেঙে গেছে। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় চাকরি পরীক্ষা বন্ধ থাকায় বেড়েছে বেকারত্ব। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়েছে, অস্থিরতা বেড়েছে।

জানা গেছে, বছর দশেক আগে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের হলে একজন করে মনোবিজ্ঞানী রাখা হয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের হলে সেই ব্যবস্থা নেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের নভেম্বরে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা এখানে কাউন্সেলিং করান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ ও একটি মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের সেবা দেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই সেই ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ জানেনই না, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কার কাছে যাবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা যে কোনো বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টার কাছে যেতাম। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্র উপদেষ্টা মারা যান। এর পর কাউন্সেলিংয়ের জন্য কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয়- ২০০ টাকার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কাউন্সেলিং করতে পারবেন।’

তিনি বলেন, ‘এমনিতেই শিক্ষার্থীরা কাউন্সেলিং করলে অন্যরা বাঁকা চোখে তাকায়, এর মধ্যে আবার ২০০ টাকা খরচ। তাই শিক্ষার্থীদের কেউ কাউন্সেলিং করতে চায় না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *