বিএমবিএস’র প্রতিবেদন ২০১৬ সালে খুন ২৪২৯

Slider জাতীয় টপ নিউজ

 

46898_b3
ঢাকা; চলতি বছরে বিভিন্ন ঘটনায় ২৪২৯ জন খুন হয়েছেন। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে হত্যার শিকার হয়েছে প্রায় ৭ জন। এর মধ্যে সন্ত্রাসীদের হাতে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যাটি ১০৫২। এরপরই রয়েছে পারিবারিক কোন্দলে নিহতের ঘটনা। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৮৪ জন নারী-পুরুষ। সামাজিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২২০ জন। এ ছাড়া শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। ক্রসফায়ারে মারা গেছে ১৫৭ জন এবং জঙ্গি হামলায় মারা গেছে আরো ৬৩ জন। সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে মারা গেছে ৩৪ বাংলাদেশি। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৬৩ জন নারী। এ তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) নামে একটি সংস্থা। এক বছরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তৈরি করা এ প্রতিবেদনে মোট ৭১টি ক্যাটাগরিতে খুনের পাশাপাশি নানা ধরনের মৃত্যু ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়াদি তুলে ধরেছে তারা। সার্বিক মানবাধিকারের চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় আরো উদ্বেগজনক। শিশু হত্যা ও নির্যাতন ছিল বছর জুড়েই। পারিবারিক কোন্দলে আহত ও নিহতের সংখ্যাও এ বছর তুলনামূলক বেশি। নারী নির্যাতন, আত্মহত্যা পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতা, কথিত ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যার ঘটনাগুলো এ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। সংস্থাটি বলছে, মানুষের পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ছে যা দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়।
সংস্থাটির গবেষণা সেলের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ২০১৬ সালে সারা দেশে সন্ত্রাসীর হাতে নিহত হয়েছে ১০৫২ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরো ৮৩৯ জন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চগড়ে মঠ পূজারীকে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মে মাসে টাঙ্গাইলে নিখিল জোয়ার্দার নামে এক দর্জি, বান্দরবানে বয়স্ক বৌদ্ধকে, জুন মাসে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় আবদুল বারেক সরদারকে নিজ ঘরে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দিনে দুপুরে চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতুকে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। অক্টোবরে রাজধানীর বনানীতে একটি বহুতল ভবনে ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যাপককে হাত-পা বেঁধে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত বছর সন্ত্রাসীর হাতে হত্যার ঘটনা ঘটে ৮২০টি। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। ১৯৭ জন শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৯৯ শিশু। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে হবিগঞ্জের সুদ্রাটিকি গ্রাম থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ৪ শিশুর মাটিচাপা লাশ উদ্ধার, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে মায়ের হাতে শিশুকন্যা, আগস্টে রাজধানীর বাসাবো এলাকায় আরেক মায়ের হাতে দুই শিশু সন্তানকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মা-বাবার হাতে সন্তান হত্যার বিষয়টি এ বছর আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম। এ বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪০৭ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ৭৭ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে। এ বছর ১৫৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত যৌতুকের জন্য প্রাণ গেছে ৬১ নারীর এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনে আহত হয়েছেন আরো ৯৪ জন নারী। সংস্থাটির মতে, যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টি বেশ উদ্বেগের। চলতি বছর পারিবারিক কলহে নিহত হয়েছেন ৩৮৪ জন ও আহত হয় ৩১৩ জন। এর মধ্যে ২৯১ জন নারী নিহত এবং আরো ২১৭ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- ফেব্রুয়ারিতে বেয়ালমারিতে ভাইয়ের হাতে বোন খুন। পাবনায় এক মা ও তার সন্তানের বিষপানে মৃত্যু। সেপ্টেম্বরে ফরিদপুরে নতুন মডেলের মোটরসাইকেল না পেয়ে নিজের মা বাবার শরীরে আগুন দিয়ে বাবাকে হত্যা। ‘কথিত’ ক্রসফায়ারে এ বছরে মারা গেছে ১৫৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের ক্রসফায়ারে ৯৬ জন, র‌্যাবের ৫৬ জন ও অন্যান্য বাহিনীর হাতে আরো ৫ জন। পুলিশ ও জেল হেফাজতে এ বছর মৃত্যু হয়েছে ৪৪ জনের। সামাজিক সহিংসতায় এ বছর নিহত হয়েছেন ২২০ জন, আহত হয়েছে আরো ৬৫৫৩ জন। সংস্থাটি বলছে, প্রলম্বিত বিচার পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এই সবকিছু মিলেই দেশের আপামর জনসাধারণের মানসিক ও মানবিক চিন্তা চেতনার অবক্ষয়ের কারণে বেড়ে গেছে সামাজিক অসন্তুষ। আর এই বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে জমিজমা, দুই গ্রামের খেলা নিয়ে বা আরো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬৪ জন। এ ছাড়া আরো আহত হয়েছেন ২৪২৪ জন। আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার বাণিজ্য, এলাকা দখল, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনের জন্য আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে আহত ১২৩৯ জন বিএনপির অন্তর্কোন্দলে আহত হয়েছেন ৯৪ জন। এসব হত্যার পাশাপাশি বিএমবিএস আরো কিছু মৃত্যুর পরিসংখ্যান ও তার কারণ তুলে ধরেছে। সংস্থাটির দেয়া তথ্য মতে, ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেছে মোট ৫১৪ জন। এদের মধ্যে ১৭৮ জন পুরুষ ও ৩৩৬ জন নারী। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমে ব্যর্থতা ও যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। মাদকের প্রভাবে বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে ৯২ জন ও নিহতের সংখ্যা ৪৫ জন। এসিড নিক্ষেপের শিকার ৩০ জন। পানিতে ডুবে, অসাবধানবশত, বিদুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে ১২৫০ জন। এ বছর চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় ৬৫ জনের। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৯৬৭ জন ও নিহত ২৪০৩ জন। গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ৫০ জনের। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১০০ জন। চলতি বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলের ১৩৭৯৭ জনেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া সংস্থাটি বলছে, এসিড নিক্ষেপে আহত হয়েছেন ৩০ জন, বিএসএফ এর নির্যাতনে আহত ৩৩ জন, বিএসএফ এর হাতে অপহরণ ৮ জন, বোমা হামলায় ১৮ জন নিহত এবং ৩৪ জন আহত, ৪ সাংবাদিক নির্যাতনে নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরো ৩৬। এ বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৪০৩ জন আহত ৪৯৬৭ জন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে ৫৭ নারী ও ৯৪ পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ১১ জন। আহত হয়েছেন ১৩ জন। চলতি বছর ২০০ জন পুরুষ এবং ৩৭ জন নারী অপহরণের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে তাদের পরিচালনা করার পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *