যেদিন সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমেছিল বঙ্গোপসাগরে

Slider জাতীয়

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসত গণমানুষের অধিকারের স্লোগান। অসুরবিনাশী সুরও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতো ওই বাড়িজুড়ে। রাজনীতি ও সংস্কৃতির মিশেলে ওখান দিন-রাত ভেসে উঠত দেশের মানচিত্র ও মানুষের ছবি। কিন্তু সেই বাড়িটিকে একদিন স্তব্ধ করে দিল এ দেশেরই কিছু বিপথগামী স্বার্থান্বেষী মানুষ। সাল ১৯৭৫, ১৫ আগস্ট। নিভিয়ে দেওয়া হলো হাজার বছরের রাজনীতির আরাধ্য পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনপ্রদীপ। একই সঙ্গে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তার প্রায় পুরো পরিবারকে। এই জঘন্যতম ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা দেশ ও বিশ^। রাজনীতি ও সংস্কৃতির শুভানুধ্যায়ী জাতির জনককে হারিয়ে সাহিত্য অঙ্গনেও ছড়িয়ে যায় চাপা ক্ষোভ, শোক। তবু হাল ছাড়েনি, আশাহত হয়নি কিছু মানুষ। বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার দিকে তাকিয়ে আশাবাদী ছিল কিছু কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিক। সেই বিশ্বাসেই হয়তো কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন ‘সিঁড়ি’ শিরোনামের কবিতাটি। ১৫ আগস্টের ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন- ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/ সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে—/ বত্রিশ নম্বর থেকে/ সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা ব’য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে …।’ এই কবিতায় তিনি আরও লিখেছেন- ‘তাঁর রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে,/সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ:/ তাঁর ছায়া দীর্ঘ হ’তে-হ’তে/ মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে!/তাঁর রক্তে সবকিছু সবুজ হয়েছে…।’ শোকে কাতর হয়ে কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘…দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ তবু নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবুর রহমান।’

আজ সেই কালো দিন। শোকাবহ ১৫ আগস্ট। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকা-ের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধূর শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মানবতার শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্রের হাতে বাঙালির নিরন্তন প্রেরণার চিরন্তন উৎস, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সেদিন ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকা-ে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, মহীয়সী নারী ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও জাতির পিতার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ এবং কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

১৫ আগস্ট নরপিশাচ খুনিরা জাতির পিতাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, হত্যার বিচার বন্ধ করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। পরে দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্কের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত করে।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ ও জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে করোনা সংকটময় এ মুহূর্তে দেশবাসীর পাশে দাঁড়াতে সবার প্রতি আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আজ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে।

ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তার নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ‘জাতির পিতার হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। তার হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল, সেটাও একদিন বের হয়ে আসবে। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারও সম্পন্ন হয়েছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে। সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের সুযোগ বন্ধ হয়েছে।’

আজ রবিবার সমগ্র জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুর ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালন করবে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্য উদয়ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের সব স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে।

সকাল পৌনে ৮টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ও মোনাজাত করবে আওয়ামী লীগ। সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। ওই কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলও যোগ দেবে। এ ছাড়াও দেশব্যাপী মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার কর্মসূচি রয়েছে।

দুপুরে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থ মানুষদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হবে। বাদ আসর মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল হবে। আগামীকাল সোমবার বেলা সাড়ে ৩টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় শোক দিবসের আলোচনাসভা হবে। এতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *