বজ্রপাতে অসহায় আত্মসমর্পণ

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


ঢাকা: দুপুরের পর থেকে মেঘাচ্ছন্ন ছিল দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার লোহাচড়া গ্রামের আকাশ। ঝুম বৃষ্টি নামে বিকালে। সঙ্গে প্রচ- মেঘের গর্জন। বৃষ্টিতে ভিজতে এ সময় ঘর ছেড়ে আঙিনায় এসে দাঁড়ায় দুই বোন আশরাফি খাতুন (১০) ও মহসিনা খাতুন (১২)। এর মধ্যেই বাড়ির পাশের গাছ থেকে আম পড়ার শব্দ পেয়ে তা কুড়াতে যায়। কিন্তু কে জানত একটু পরেই তাদের জীবনে নেমে আসবে কালো মেঘ। বিকট আওয়াজে আকাশ থেকে নেমে আসা বজ্র ঝলসে দিয়ে যায় কোমল দুটি শরীর। গত রবিবার ওই ঘটনার দিনই বজ্রপাতে সারাদেশে মৃত্যু হয় ২১ জনের।

মূলত জুন মাসকে বলা হয় বজ্রপাতের উর্বর মৌসুম। প্রতিদিন ঝড়োবৃষ্টির সময় দেশের কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। আহতের সংখ্যাও কম নয়। সম্প্রতি রাজধানীতেই বজ্রপাতের সময় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে মৃত্যু হয় দুই শিশুসহ তিনজনের। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, চলতি জুনের প্রথম সপ্তাহেই মারা গেছেন ৬৫ জন। আর মার্চ থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সারাদেশে বজ্রাঘাতে ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। যেখানে গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৩৩ জনের মতো। আহতের সংখ্যাটা ছিল ১২৩ জন। আর ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সারাদেশে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৬৭৮ জনের।

বজ্রপাতে হতাহতের বা ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ছয় দফা দাবি তুলে ধরে এসব তথ্য দেয় সামাজিক সংগঠন ‘সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম’ (এসএসটিএএফ)। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। এ সময় অন্যদের মধ্যে বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ড. মুনির আহমেদ, আইডিইবি রিসার্চ ও টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো মো. মনির হোসেন, এসএসটিএএফের সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা, নির্বাহী প্রধান (গবেষণা সেল) আব্দুল আলীম, ভাইস প্রেসিডেন্ট এমদাদ হোসাইন মিয়া, নির্বাহী পরিচালক রানা ভূঁইয়া, নূরে আলম জিকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বজ্রপাতে হতাহতের কোনো ঘটনা না থাকলেও মার্চের শেষদিকে প্রাণহানির ঘটনা বাড়তে থাকে। গত তিন-চার মাসে শুধু কৃষিকাজ করতে গিয়েই বজ্রাঘাতে প্রাণ গেছে ১২২ জনের। আম কুড়াতে গিয়ে বজ্রপাতে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। ঘরে অবস্থানকালেও বজ্রপাতে ১০ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া নৌকায় মাছ ধরার সময় ৬ জন, মাঠে গরু আনতে গিয়ে ৫ জন, মাঠে খেলার সময় ৩ জন, বাড়ির আঙিনায় বা উঠানে ৬ জন, ভ্যান ও রিকশা চালানোর সময় ২ জন এবং গাড়ির ভেতরে অবস্থানের সময় ১ জনের মৃত্যু হয় বজ্রপাতে।

হতাহতের হিসাবে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা আগে নেত্রকোনা, নরসিংদী, কুমিল্লা মিলে দেশের মধ্যাঞ্চলকে ‘বজ্রপাতের হটস্পট’ বলে মনে করলেও চলতি বছর নতুন হটস্পট হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন সিরাজগঞ্জকে। এ জেলায় চলতি বছরের মে মাস ও জুনের শুরুতেই বজ্রপাতে মারা গেছেন ১৮ জন। এ ছাড়া চলতি বছরের চার মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৬, জামালপুরে ১৪, নেত্রকোনায় ১৩ ও চট্টগ্রামে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বছরটির মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১৪৯ ও নারী ২৮ জন। তাদের মধ্যে শিশু ১৩ জন, কিশোর ৬ ও কিশোরী ৩ জন। মৃত্যুর পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে বজ্রপাতে আহত হয়েছেন ৪৭ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৪০ ও নারী ৭ জন।

দাবিগুলোর পাশাপাশি ভয়ঙ্কর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে জানমাল রক্ষা করতে বাংলাদেশে এই প্রথম বজ্রাঘাতের আগাম খবর জানানোর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ আনার ইঙ্গিতও দিয়েছেন এসএসটিএএফের নেতারা। তারা বলেন, এই অ্যাপ মুঠোফোনে ইনস্টল করা থাকলে বজ্রপাতের অনেক আগেই সতর্ক সংকেত মিলবে। নির্দিষ্ট জায়গায় বজ্রপাত হওয়ার আধ ঘণ্টা আগে এই অ্যাপ নিজে থেকেই ব্যবহারকারীদের নোটিফিকেশন পাঠাবে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, আঘাত অনুযায়ী বজ্রপাত তিন প্রকার এবং পোলারিটি বা চার্জ অনুযায়ী এই দুর্যোগ চার প্রকার। সেগুলোর একটি হয় মেঘের মধ্যে, অপরটি মেঘ থেকে মেঘে, তৃতীয় বজ্রপাতটি হয় মাটি স্পর্শ করে। এ ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী তৃতীয়টি। তবে বজ্রপাত মেঘের মধ্যেই হোক কিংবা মাটিতে এসে স্পর্শ করুক ব্যবহারকারীদের বর্তমান অবস্থান থেকে ২০ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি হবে কিনা তা আগেভাগেই বলে দেবে নতুন এই অ্যাপ। আর সেই পূর্বাভাস বার্তা ওই নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থানকাল থেকে ৩০ মিনিটের জন্য প্রযোজ্য হবে। পরবর্তী সময়ের জন্য ক্রমাগত আপডেট দেবে অ্যাপটি; ফলে বজ্রাঘাতের আগেই নিরাপদে সরে যেতে পারবে মানুষ। কমবে বহু হতাহতের সংখ্যাও।

এসএসটিএএফের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশিম মোল্লা ছয় দফা দাবি তুলে ধরে বলেন, ‘ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুর হার যতটা, তার চেয়েও অনেক বেশি বজ্রপাতে। অথচ বজ্রপাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করা হলেও তা মোকাবিলায় বরাদ্দ কম। তাই মানুষের জীবন রক্ষার্থে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে; মাঠ, হাওর-বাঁওড়ে বা ফাঁকা কৃষিকাজের এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। তার ওপরে স্থাপন করতে হবে বজ্র নিরোধক, যেন বজ্রপাতের সময় কৃষক ও শ্রমিকরা সেখানে অবস্থান বা আশ্রয় নিতে পারেন। বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে থান্ডার প্রোটেকশন সিস্টেমের সব পণ্যে শুল্ক মওকুফ করতে হবে। সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি বজ্র নিরোধক স্থাপনের ঘোষণা দিতে হবে। তবে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা যুক্ত না থাকলে নতুন কোনো ভবনের নকশা অনুমোদন না দিতেও আহ্বান জানাই আমরা।’

আইডিইবি রিসার্চ ও টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো মো. মনির হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে বেশি কার্যকর আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম। ওই সময় মানুষ ঘরের বাইরে কম বের হলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। এ ব্যবস্থা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কাজে লাগিয়ে বেশ সাড়া পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারিভাবে রাস্তার পাশে তালগাছ এবং মাঠে বজ্রনিরোধক দ- স্থাপন করা গেলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। বজ্রাঘাত এড়াতে সর্বোপরি মানুষকে সচেতন হতে হবে।’

বজ্রপাত প্রবণতা অনুযায়ী সাধারণ মানুষের সতর্কতামূলক করণীয় বিষয়ে তিনি জানান, খোলা স্থানে অবস্থান না করে দ্রুত শুকনা ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। বড় বড় গাছের নিচে অর্থাৎ গাছ ঘেঁষে না দাঁড়ানো এবং অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে আশ্রয় না নেওয়া। মাথায় ছাতা ব্যবহারে বিরত থাকা। বাড়ি-ঘরে থাকলে খোলা দরজা-জানালার পাশে ও বাড়ির ছাদে অবস্থান না করা। এ সময় ধাতব নির্মিত বস্তু, পানির কল, পাইপ রেলিং থেকে দূরে থাকা। নৌযানে অবস্থানকালে বাইরে না থেকে যানের ভেতরে অবস্থান করা।

গাড়িতে অবস্থানকালে বজ্রপাতের প্রকোপ বেশি দেখা দিলে গাড়ি বন্ধ রেখে অপেক্ষা করা। খোলা মাঠে কাজের সময় আশপাশে কোনো আশ্রয় স্থান না থাকলে পায়ে জুতা পরা এবং মাথা অপেক্ষাকৃত নিচু করে দুই পা একত্রিত করে বসে অপেক্ষা করা। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজারে যাতায়াতের সময় বজ্রপাতপ্রবণতা দেখা গেলে দ্রুত আশপাশের বাড়ি-ঘরে আশ্রয় নেওয়া। পুকুর, ডোবা, খাল-বিলে থাকলে দ্রুত তীরে উঠে আশ্রয়স্থল খুঁজে নেওয়া। বজ্রপাতের সময় ভেজা স্থানের চেয়ে শুকনা স্থান বেশি নিরাপদ। তাই শুকনা স্থানে আশ্রয় নেওয়া। অধিকাংশ মানুষ প্রাণ হারায় উচ্চশব্দে, তাই এ সময় দুই হাত দিয়ে কান চেপে রাখা উচিত। ল্যান্ডফোন ও মোবাইল ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। বাড়ির ভেতরে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বন্ধ রাখা।

অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ লাইনে এসপিডি ব্যবহার করা। বাড়ি-ঘরে ও স্থাপনায় বজ্রপাত সুরক্ষা ব্যবস্থা আর্থিং সিস্টেম স্থাপন জরুরি। গ্রামের টিনের চালা, শেড বা মাটির ঘরে, যেখানে আশপাশে উঁচু গাছপালা নেই এমন স্থানের ১০-২০ ফুট দূরে ৪০-৫০ ফুট লম্বা বাঁশের সঙ্গে ধাতব তার সংযুক্ত করে তারের নিচের অংশ দূরে মাটির ৫-৭ ফুট নিচে পুঁতে আর্থিং সচল রাখা। বজ্রপাতের সময় অনেক লোক এক জায়গায় জড়ো না থেকে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে অবস্থান করা। বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত থাকা।

পাহাড়ে থাকলে ওপর থেকে দ্রুত ঢালুতে আশ্রয় নেওয়া। বন-জঙ্গলের ভেতরে থাকলে অপেক্ষাকৃত ছোট গাছের কাছাকাছি থাকতে হবে। বিমানে থাকলে নিশ্চিত হোন, সেটি বজ্রপাত সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে কিনা। হাওরের বা বিলের মাঝে নৌকায় থাকলে নৌকা থামিয়ে পাটাতনের ওপরে শুকনা স্থানে অবস্থান করা এবং পানির সংস্পর্শে না থাকা। বজ্রপাত প্রবণতা দেখা দিলে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। ধাতব তৈরি যন্ত্রপাতিচালিত অবস্থায় থাকলে তা বন্ধ করে একটু দূরে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাত এড়াতে রাস্তায় ঘন ঘন করে তালগাছ লাগানোরও পরামর্শ দেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মো. মনির হোসেন।

বজ্রপাতে ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে সতর্কতা অবলম্বনে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সম্প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও। সেগুলো হলো- বজ্রঝড় সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটের মতো স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করা। অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে বজ্রঝড় বা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা পেতে রাবারের জুতা পরে বাইরে যেতে হবে। ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে। বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে, ছাদে বা উঁচু ভূমিতে যাওয়া উচিত হবে না। শিশুদের ঘরের ভেতরে রাখতে হবে।

বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে এমনকি জনাকীর্ণ স্থানে থাকাও বিপজ্জনক। খালি জায়গায় উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব পদার্থ বা মোবাইল টাওয়ার থাকলে তার কাছাকাছিও থাকা যাবে না। ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে না যাওয়াই উত্তম। সমুদ্রে বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। যদি কেউ গাড়ির ভেতর অবস্থান করেন, তাহলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *