বাড়িতে বাড়িতে টু লেট, রাজধানীতে একতৃতীয়াংশ কমেও মিলছে না ভাড়াটিয়া!

Slider বাংলার মুখোমুখি

ঢাকা: করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় নাভিশ^াস নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবন। চাকরি খুইয়েছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। দিনমজুর থেকে শুরু করে চাকরিজীবী- সবার উপার্জনেই এ বৈরী হাওয়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাকরিপ্রত্যাশী বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীও। করোনার প্রভাবে সরকারি নিয়োগ বন্ধ থাকায়, এরা শঙ্কিত চাকরির বয়স নিয়ে। টিকতে না পেরে অনেকে তাই একেবারে চলে গেছেন ঢাকা ছেড়েই। অনেকে আবার পরিবারের সদস্যদের স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজের জন্য খুঁজে নিয়েছেন কোনোরকম মাথা গোঁজার ঠাঁই। এর প্রভাব পড়েছে বাড়িওয়ালাদের উপরেও। টু-লেট ঝুলছে রাজধানীর প্রায় বাড়িতেই। ভাড়া কমিয়েও মিলছে না তেমন ভাড়াটিয়া।

আজিমপুরের নিউপল্টন লাইন এলাকার বাড়িওয়ালা খোরশেদ আলম। প্রায় তিন মাস ধরে খালি পড়ে রয়েছে তার দুটি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে একটিতে থাকতেন চাকরিপ্রত্যাশী কয়েকজন শিক্ষার্থী। মাস তিনেক আগে তারা বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। অন্য একটি বাসায় থাকতেন বেসরকারি এক চাকরিজীবী। কাজ হারিয়ে তিনিও বাসা ছেড়েছেন। বাড়িওয়ালা খোরশেদ আলম বলেন, ‘তিন মাস ধরে টু-লেট ঝুলিয়ে রেখেছি। কিন্তু চাহিদামতো ভাড়াটিয়া মিলছে না। অনেক সময় কেউ কেউ এলেও বাসাভাড়া অনেক কম বলছেন। ফলে ফ্ল্যাটগুলো আর ভাড়া দেওয়া হয়নি।’

রাজধানীর শান্তিনগর, আজিমপুর, লালবাগ, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, বিজয়নগর, মালিবাগ, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন লেন, রামপুরা, খিলগাঁও, গোরানসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাড়িতে বাড়িতে দেখা গেছে টু-লেট। এমনকি অলি-গলির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দেয়ালও ছেয়ে গেছে বাসাভাড়ার বিজ্ঞাপনে। বিশেষ করে তুলনামূলক মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের যেসব এলাকায় বাস, সেগুলোতেই বাসা ফাঁক থাকার হার অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে চার-পাঁচ মাস ধরেও ভাড়াটিয়া মিলছে না। তবে অনেকের দাবি, করোনায় আয় কমে যাওয়ায় ভাড়া দিতে সমস্যায় পড়ছেন। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পরও বাসাভাড়া কমাচ্ছেন না মালিকরা। ফলে বাধ্য হয়ে তুলনামূলক কম ভাড়ার বাসা খুঁজে নিতে হচ্ছে।

মালিবাগ রেলগেট এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন আল-আমিন মিয়া। কাজ করতেন বিমানবন্দরে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের সহকারী হিসেবে। তবে করোনার প্রভাবে আয় কমে যাওয়ায় ঠিকমতো সংসার চালাতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়েই পরিবারের অন্য সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন ঈদের আগে। তিনি গিয়ে উঠেছেন একটি মেসে। আল-আমিন বলেন, ‘আসলে কোনো উপায় নেই। বর্তমানে আয় নেই বললেই চলে। এভাবে আর পারছিলাম না। তাই সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।’

শাহেনশাহ রঞ্জু নামের খিলগাঁও এলাকার একজন বাড়িওয়ালা বলেন, ‘বাসা-বাড়ির মালিক হলে অনেকে মনে করেন বড়লোক হয়ে গেছি। এই দেখেন না, গত দুই মাস ভাড়াটিয়া নেই। কিন্তু তাই বলে কি গ্যাসের বিল, পানির বিল মাফ হয়ে যাবে? লাইন ঠিক রাখতে এগুলো তো আমাকেই গুনতে হচ্ছে। চলতি মাসেও ভাড়াটিয়া পাব কিনা জানি না। টু-লেট টানিয়ে রেখেছি, দেখা যাক কী হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সময় ভাড়াটিয়া ফোন করলেও আগে জানতে চান- ভাড়া কত? ভাড়ার কথা শুনে কেউ আর বাসা দেখতেও আসেন না।’

ফকিরাপুল-আরামবাগ এলাকায় প্রকট ভাড়াটিয়া সংকট। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও সচিবালয়ের কাছাকাছি বলে এই এলাকায় বাসাভাড়ার চাহিদা বেশি, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের বাসও কম নয়। ঘনবসতিপূর্ণ এসব এলাকায় রয়েছে বহু ব্যাচেলর মেসও। ফকিরাপুলের গরম পানির গলি, করিম মেস- এমন কয়েকটি জায়গা আছে যেখানে প্রতি মাসেই ভাড়াটিয়া বদল হয়, নতুন ভাড়াটিয়া আসে। ফকিরাপুলের মেসে থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের কারণে ব্যাচেলররা অনেকেই বাড়ি চলে গেছেন। আমারও যাওয়ার কথা ছিল, বাস না চলায় আটকে গেছি। এখানকার প্রায় মেসই এখন বন্ধ। কারণ এগুলোতে যে কাজের মহিলারা থাকেন তারাও বাড়ি চলে গেছেন। অনেক শিক্ষার্থী থাকতেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাই অনেকেই স্থায়ীভাবে মেস ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন।’

শান্তিবাগ মোড়ে ঢুকতেই হাতের দুদিকে বাসাভাড়ার অসংখ্য বিজ্ঞাপন দেয়ালে ঝোলানো। প্রতিদিন বাড়ি কিংবা রুম খুঁজতে এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। কিন্তু কয়েক মাস ধরে এখন আর সেভাবে বিজ্ঞাপন দেখার মানুষ আসেন না বলে জানালেন সেখানকার চা বিক্রেতা ওসমান আলী। তিনি বলেন, ‘এখন বাড়ি ভাড়ার মানুষজন সেভাবে এখানে দেখি না। গত কয়েকদিনে একজন মানুষকেও দেখিনি দেয়ালের লেখা পড়তে।’ তিনি বলেন, ‘হোসাফ টাওয়ারের সামনে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা চলত, যারা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী কিংবা ছোটখাটো চাকরি করতেন। কিন্তু কয়েকমাস ধরে এ জায়গা খালিই পড়ে থাকে। আমার বেচাবিক্রিও প্রায় বন্ধ।’

শাহবাগ এলাকায় ফুটপাতে একটি হোটেল পরিচালনা করেন জামশেদ আলী। থাকতেন হাতিরপুল। কিন্তু খরচ চালাতে না পেরে গত মাসে সেই এলাকা ছেড়ে নতুন বাসা নিয়েছেন আজিমপুরে। জামশেদ বলেন, ‘আগের মতো ইনকাম নেই। হাতিরপুলে ভাড়া বেশি। তাই আজিমপুরের দিকে চলে গেছি। সেখানে বাসাভাড়া তুলনামূলক কম।’ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘হাজারিবাগের এনায়েতগঞ্জের ৩৭/সি বাসায় থেকেছি দীর্ঘ বছর। চার মাস আগে বাসা পরিবর্তন করেছি। কিন্তু পুরনো বাসাটি এখনো ভাড়া হয়নি। সেই মালিক আক্ষেপ করে অনেক কথাই বললেন।’

মিরপুরের ইবরাহিমপুরে দুই রুমের একটি বাসায় উঠেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী ইমতিয়াজ আলম। তিনি বলেন, ‘আগে মাসে ১৫ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকতাম। কিন্তু আয় কমে গেছে। তাই কম টাকায় ভাড়া খুঁজছিলাম। নতুন বাসাটি ১০ হাজার টাকায় নিয়েছি। অন্য সময় এ বাসাটির ভাড়া ছিল ১৪ হাজার টাকা। কয়েক মাস ফাঁকা থাকার পরও ভাড়া না হওয়ায় বাড়ির মালিক এ টাকাতেই দিতে রাজি হয়েছেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *