সখী তুমি কার গো!

Slider বাধ ভাঙ্গা মত সম্পাদকীয়

সখী তুমি কার, আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ১৯৮০ সালের বাংলাদেশী রোমান্টিক-নাট্য চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি রচনা করেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। ত্রিভুজ প্রেমের এই চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, শাবানা ও ফারুক। কাহিনীতে শাবানাকে নিয়ে নায়কদের টানাটানি ত্রিভুজ প্রেমের এই ছবিকে জনপ্রিয় করেছিল। এই ছবিতে একটি গানের প্রথম চার লাইন হল,

ওই দূরের আকাশ আজ রঙিন হল
বদলে যাওয়ার নিয়মে,
তাই বদলে গেছে সব ইচ্ছেগুলো
সঙ্গী করে তোমাকে…

মুকুল চৌধুরীর লেখা এই গান রুনা লায়লার কন্ঠে সিনেমাটিকে জনপ্রিয় করেছিল। এই ছবির আরেকটি গান একই লেখকের লেখা কিন্তু গেয়েছিলেন আঃ জব্বার। গানটির প্রথম দুটি লাইন হল,

তুমি আছো সবই আছে জীবনে আমার।
তুমি নাই কিছু নাই ভুবনে আমার।

মহাভারত থেকে পাকিস্তান। পাকিস্তানের পূর্ব অংশ মানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। এই সব হয়েছে যুদ্ধ করেই। প্রাণের বিনিময়ে প্রাণের শান্তি। আর সেই প্রাণটি হল জনগন। জনগনের মঙ্গলের জন্যই রক্তের বিনিময়ে সুখ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এই সোনার হরিণী সুখের সৌভাগ্যবান হওয়ার কথা ছিল জনগনের। জনগনের স্বাধীনতা ও ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঘটেছিল যুদ্ধ আর যুদ্ধ। রক্তমাখা সম্ভ্রম আর বীভৎস লাশের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে বার বার। কোন যুদ্ধই বিফলে যায়নি। তবে সফল হয়েও ফল হয়নি। কারণ যে ফলের জন্য ‍যুদ্ধ করি, সে ফল আর হাতে আসে না। জেলখানার ভেতরে যেমন সেল থাকে, ঠিক স্বাধীনতার ভেতরেও স্বাধীনতার সেল থাকে। স্বাধীনতার সংগ্রাম একটি পতাকা ও মানচিত্র দিতে পারছে কিন্তু রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। জনগন যুদ্ধ করছে, রক্ত দিচ্ছে, ইজ্জ্বত দিচ্ছে, বিনিময়ে স্বাধীনতা পাচ্ছে কিন্তু স্বাধীন হতে পারছে না। এই কষ্ট যাওয়ার লক্ষণও কম।

‘সখী তুমি কার’ সিনেমায় নায়িকা শাবানা। ত্রিভুজ প্রেমের ছবি। রজ্জাক, ফারুক দুই জনই জনপ্রিয় নায়ক। একজন জীবিত, আরেকজন পরপারে চলে গেছেন। সিনেমায় শাবানাকে নিয়ে ত্রিভুজ প্রেম জমেছিল। শাবানাকে কে পাবেন, সেটাই ছিল কাহিনীর মূল আকর্ষণ। যিনি পেয়েছিলেন তিনি আজ নেই। বেঁচে আছেন শাবানা।

কথাগুলো বলার কারণ হল, বাংলাদেশ এখন শাবানার মত হয়ে গেছে। শাবানা যদি রাষ্ট্র ও জনগন হয়, তবে সখী তুমি কার।

প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল থাকলেও একটির ভেতরে আরেকটি চলে যাওয়ায় দুটিই বলা যায় কি? যদিও মাঠে ময়দানে তিন দলই বলছে, জনগন আমাদের। ক্ষমতাসীন দল বলছে, জনগন আমাদের সঙ্গে। বিএনপি বলছে, জনগন তাদের সঙ্গে। জাতীয় পার্টি বলছে, জনগন আওয়ামীলীগ ও বিএনপির সঙ্গে নেই, জনগন তাদের সঙ্গে আছে। ছবির সাথে ‍মিলিয়ে মজা করে বলতে হয়, “জনগন এখন শাবানা”! যে ডাকে তার কাছেই যায়। তবে কার সঙ্গে প্রেম বুঝা বড় দায়।

বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি আমরা। ৫০ বছর বয়সী কোন মানুষের জন্মের ইতিহাস যদি চূড়ান্ত না হয়, তবে ওই মানুষটির সামনের দিনগুলো কেমন যাবে। নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা নিশ্চিত না করে অসময়ে বিয়ে করানোটাও ঠিক হবে না। কারণ বাচ্চারও বাবার দশা হতে পারে।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের ইতিহাস এক এক সময় এক এক রকম লেখা হয়। আমাদের স্বাধীন দেশের একটি সংবিধান আছে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ এক আঙ্গুলির জায়গা দখল করতে না পারলেও সংবিধান ছাড়া চলতে পারা বড় বড় দেশের মত নই আমরা। আমরা আমাদের সংবিধানকে ১৬বার কাটা ছেঁড়া করেছি। সংবিধানের দুটি আর পাঁচটি নয়, ১৫৪টি অনুচ্ছেদও আমাদের জন্য যথেষ্ট হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, সংবিধানেকে আরো কাটাকাটি করতে হবে, আরো অনুচ্ছেদ লাগবে। অথচ সংবিধান ছাড়াই চলছে বিশ্বের অনেক বড় বড় রাষ্ট্র। এসবই আমাদের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকার কারণে চাহিদা তৈরী হওয়ার কারণ।

আমরা সিটিং রাষ্ট্রপতিকে স্বপরিবারে নৃশংসভাবে খুন করতে পারি আবার সিঙ্গেলও পারি। আমরা বার বার সামরিক শাসনে শাসিত হতে পারি। আমরা ভোট ছাড়াই ক্ষমতা চালাতে পারি। আমরা হ্যাঁ বা না ভোট দিয়েও চলতে পারি। ভোট ভোট খেলা করে নিজেদের মত ফল তৈরী করে ৯ বছর থেকে এক যুগও ক্ষমতায় থাকতে পারি। আমরা স্বাধীনতার পর স্বাধীন দেশে গনতন্ত্রের জন্য রক্ত দিতে পারি। যারা রক্ত চুষে লাশ বানায় তাদের সঙ্গেও ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে পারি। আমরা ক্ষমতার জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব এক ব্যাক্তিকেও দিতে পারি। আমরা লাশের উপর নৃত্য করতে পারি ক্ষমতার জন্য।

আমরা জাতীয় প্রতীক ঘরে ঘরে ‍দিয়ে বিভাজন তৈরী করে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারি। দেশের জনগনকে নানা ভাগে ভাগ করতে পারি আমরা। এটাকেই আমাদের গনতন্ত্র বলে।

মিডিয়ায় যা বলা হয়, তার কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা, তা আবেগীবক্তা বুঝতে না পারলেও জনগন বুঝে। এই বুঝা আর না বুঝার মধ্যে কোন পার্থক্যও নেই। কারণ ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভোটার খুন হয়।
সারাদেশে জঙ্গী হামলা হয়। গাড়িতে বাড়িতে রাস্তাঘাটে আগুন দিয়ে ভোটার ও ভোটারের সম্পদ পুঁড়িয়ে ফেলা হয় এমনকি ভোটকেন্দ্রও জ্বালিয়ে দিতে পারি আমরা শুধু ক্ষমতার জন্য। তাই জীবনের ভয়ে জনগনকে আর কষ্ট করে ভোট দিতে হচ্ছে না। ভোট দিয়ে লাশ হতে বা মার খেতে বা জেলে যেতে ভোটাররা এখন আর ভোটে যেতে চান না। ভোটাররা এখন কথাও বলতে চান না। কারণ ঠিকঠাকত কথা বলতে না পারলেও জেলে যেতে হবে। যে দল ক্ষমতায় থাকবে তাদের প্রশংসা না করতে পারলে জেলে যেতে হবে তাই কথাও বলতে চায় না জনগন। কথা নিয়ন্ত্রনেও আইন আছে।

সুতরাং ভোটারদের আর বিরক্ত না করাই উত্তম হবে। কারণ তারা ভোট দিতে চায় না। কথাও বলতে চায় না। ফলে এই অভাগা ভোটাররা কোন দলের তা বলাও ঠিক না। তাই কথায় কথায় জনগন আমার বা আমাদের এটা বলার সময় মনে হয় এখন আর নেই। এখন বাংলা সিনেমার নামটিই বাস্তব। সখী তুমি কার?

ড.এ কে এম রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *