ঘরবন্দি রাজনীতির বছর

Slider জাতীয়


বছরের শুরুটা হয়েছিল অনেকটা স্বাভাবিক নিয়মেই। পুরো বছরের রাজনৈতিক ছক বুনে রাজনৈতিক দলগুলোর যখন প্রস্তুতি নেয়ার পালা ঠিক তখনই দুনিয়াজুড়ে করোনাভাইরাসের হানা। ঘরবন্দি হয়ে পড়ে মানুষ। ঘরবন্দি রাজনীতি। মহামারিকাল দীর্ঘায়িত হওয়ায় প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ আবার কর্মব্যস্ত। ভাইরাসের ভয় কাটিয়ে জীবন-জীবিকার জন্য স্বাভাবিক রূপে জীবনযাত্রা। তবে ঘরবন্দি রাজনীতি এখনো বাইরে আসতে পারছে না বিধি-নিষেধের কারণে। বছরের শুরুতেই করোনাভাইরাসের হানা দেয়ার পর থেকে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়ে।
সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ের মতো জন সমাগম হয় এমন কর্মসূচি পালন করছে না রাজনৈতিক দলগুলো। তবে নিয়মিত কার্যক্রম চালানোর অংশ হিসেবে অনলাইন মাধ্যমে চালানো হচ্ছে কিছু কার্যক্রম। ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে হচ্ছে সভা- সেমিনার। রাজনীতিবিদরা বলছেন, দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন নিষ্ক্রিয় সময় আগে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের আগের বছরটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। সরকার এই বছরকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করে এক বছরের ব্যাপক আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু করোনায় সব তছনছ হয়ে গেছে। মুজিববর্ষের বেশির ভাগ কর্মসূচিই বাতিল করতে হয়েছে। যদিও বছর শেষে মুজিববর্ষের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৯ মাস। তবে সামনের সময়টুকুও কেমন হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

রাজনীতির মাঠে সব সময়ই উত্তাপ ছড়ায় ভোট। করোনার কারণে শুরুতে অনেক সময় সব ধরনের নির্বাচনী কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে পরে কিছু নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। এসব নির্বাচনেও দেখা গেছে করোনাভাইরাসের প্রভাব। কম ভোটার উপস্থিতির পাশাপাশি নির্বাচনী আমেজও ছিল অনুপস্থিত। বছরের শেষ ভাগে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই কয়েকটি ইস্যু ঘিরে ইসলামপন্থি দলগুলোর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে সভা- সমাবেশ না করলেও হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ইসলামী দলগুলো কয়েক দফা সভা-সমাবেশ করেছে। ফ্রান্সে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন প্রকাশের প্রতিবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দল। সর্বশেষ ভাস্কর্য ইস্যুতে আবার সরব হয় দলগুলো। এই ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত আলোচনায় বসেন আলেম-ওলামারা। ভাস্কর্য ইস্যুতে ইসলামী দলগুলোর দাবির বিপরীতে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের কর্মসূচিও রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা হলেও উত্তাপ ছড়ায়। ওদিকে হেফাজতের প্রয়াত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর আগে হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার অপসারণ দাবি করে নজিরবিহীন ছাত্র আন্দোলন হয়। কওমি মাদ্রাসায় এ ধরনের আন্দোলন এর আগে দেখা যায়নি। আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের নতুন মেরুকরণও ছিল তখন আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে নানা ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ও তার সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ। সর্বশেষ রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে আলোচনার জন্ম দেন নুর। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতেও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে বছরজুড়ে।

আওয়ামী লীগ: মুজিববর্ষের জমকালো আয়োজনের পাশাপাশি দল গোছানোর পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগের। বছরের শুরুতে এমন পরিকল্পনা নিয়ে এগোলেও করোনা এসে সব থামিয়ে দেয়। করোনার কারণে দলীয় কর্মসূচি সীমিত করা হয়। যেসব কর্মসূচি পালন হয়েছে তার বেশির ভাগই ভার্চ্যুয়ালি হয়েছে। ঘরের বাইরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব একটা না থাকলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরজুড়েই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের নিবিড় তদারকি করে যাচ্ছেন তিনি। গণভবন থেকেই ভার্চ্যুয়ালি দলীয় কর্মসূচিতে যুক্ত হচ্ছেন নিয়মিত। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা আসার পর থেকে সরকারি বাসা থেকেই ভার্চ্যুয়ালি সংবাদ সম্মেলন করছেন নিয়মিত। এ ছাড়া দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনাও দিচ্ছেন। করোনাকালে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা, সচেতনতামূলক কর্মসূচিতেও কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে কাজ করেছেন পুরো সময়। সাংগঠনিক কার্যক্রমের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য কয়েকটি পদ পূরণ করা হয়েছে, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ও মানবসম্পদ উপ-কমিটি গঠিত হয়েছে। দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের কার্যক্রমও খুব একটা ছিল না বিদায়ী বছরে। রাজনৈতিক এ জোটের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল ঘরোয়া বৈঠক আর বিবৃতিতে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, করোনার কারণে অনেক কর্মসূচি বাতিল করতে হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সব সময়ই জনগণের পাশে ছিল। নতুন বছরে অসমাপ্ত কাজ এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারের লক্ষ্য রয়েছে।

ছোট কর্মসূচিতেই বছর পার বিএনপি’র: অনেকটা নিয়মবাঁধা ছোট কর্মসূচিতেই বছর পার করেছে বিএনপি। দোয়া মাহফিল, কালো পতাকা মিছিল, মানববন্ধন আর ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভার বাইরে খুব একটা কর্মসূচি দেখা যায়নি দলটির। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নিজেদের ঘর গোছানোতেই মনোযোগী হয় বিএনপি। চলতি বছরের শুরুতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বেশ চাঙ্গা হয় দলটি। যদিও এই দুই নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে গত ২রা ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে হরতাল পালন করে বিএনপি। এটাই ছিল বিএনপি’র একমাত্র হরতাল পালন। এ ছাড়া গত ৮ই ফেব্রুয়ারি দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবন্দিত্বের দুই বছর উপলক্ষে নয়াপল্টনস্থ বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বছরের একমাত্র সমাবেশ করে বিএনপি। করোনার মাঝে মানবিক দিক এবং বয়স বিবেচনা করে শর্তসাপেক্ষে বেগম খালেদা জিয়াকে ৭৭৬ দিন পর মুক্তি দেয় সরকার। চলতি বছরে বিএনপি’র জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে বড় স্বস্তির খবর। তারপর থেকে তিনি গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ রয়েছেন।

করোনার কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ থাকলেও নিজেদের সাধ্যমতো সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। পুরো বছরজুড়ে প্রেস ক্লাবভিত্তিক মানববন্ধন এবং আলোচনায় সরব ছিলেন দলের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক ভার্চ্যুয়াল সভা, সেমিনার এবং নয়াপল্টন এবং গুলশানস্থ চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে নিয়মিত।
সর্বশেষ দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে গত ১৪ই ডিসেম্বর বিএনপি’র দুই ভাইস চেয়ারম্যান (অব.) মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) পাঠায় বিএনপি। এতে দলে খানিকটা উত্তাপ দেখা দেয়।

করোনা মহামারির মধ্যেই গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। অবশ্য পরবর্তীতে ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি উপনির্বাচনে দলটি অংশ নিয়েছে। কয়েকটি উপনির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবাদে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে দলটি।

বিদায়ী বছরের মূল্যায়ন ও নতুন বছরের পরিকল্পনার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মানবজমিনকে বলেন, এই বছরটা শুধু বিএনপি’র জন্য নয়, সারা দেশ এবং বিশ্বের জন্য ছিল অন্ধকার সময়। এই করোনার জন্য বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে। সারা পৃথিবীতেও একই ঘটনা। আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে এমনিতেই কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিলাম। এর মধ্যে টুকটাক কার্যক্রম যতটুকু সম্ভব আমরা সেটা করেছি। কিছু কিছু অঙ্গ সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সব শেষে বলতে হয় খুব ডিফিকাল্ট একটা বছর পার করেছি আমরা।

তিনি বলেন, সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেছে। তবু আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি দেশের মানুষকে জানানোর জন্য। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নতুন বছরেও এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দল: সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বছরের শুরুতেই কাউন্সিলের পর তৃণমূলে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করলেও মহামারিতে সে কাজ থমকে যায়। কাউন্সিলে মহাসচিব হয়েছিলেন মশিউর রহমান রাঙ্গা। কিন্তু জুলাই মাসে মহাসচিব পদ থেকে তাকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে বসানো হয়। করোনাকালে দলটির বড় কোনো কর্মসূচি না থাকলেও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা এবং ঘরোয়া বৈঠক হয়েছে। বছরের মাঝামাঝিতে গণফোরামে মতবিরোধ দেখা দিলেও বছর শেষে ঐক্যবদ্ধ কাউন্সিল করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জেএসডি, নাগরিক ঐক্যসহ কয়েকটি দলের কিছু কার্যক্রম থাকলেও ২০ দলীয় জোটের অন্যদলগুলো ছিল অনেকটা নিষ্ক্রিয়। শ্রম অধিকার রক্ষার দাবিতে বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, বামজোটসহ বামদলগুলো সভা-সমাবেশ করেছে নিয়মিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *