সাবধান; লেখালেখি বাদ দেন!

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি


বাণী ইয়াসমিন হাসি: বিবেক বুদ্ধি ও চেতনা মানুষের সর্বপ্রধান শ্রেষ্ঠত্ব। একবার হাসান বসরী (রা:) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, আবু সায়ীদ! বলুন, আমাদের কী করা উচিত? আমরা কি এমন লোকদের সাথে বসবো, যারা এত ভয়ের কথা বলে যে, আমাদের প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহর কসম! যারা তোমাকে ভয় দেখিয়ে সবধান করে, যার কারণে তুমি (ঐ ভীতিকর বিপদ থেকে মুক্তির উপায় অন্বেষণ করবে এবং) মুক্তি পেয়ে যাবে-তাদের সাথে থাকাই তোমার জন্য কল্যাণকর ঐ সকল লোকদের সাথে থাকার চেয়ে, যারা তোমাকে আশ্বস্ত করতে থাকে (ফলে তুমি বিপদ সম্পর্কে উদাসীন হবে এবং) পরিশেষে ঐ ভীতিকর বিপদের শিকার হয়ে যাবে।

এলেনর রুজভেল্ট এবং মানবাধিকার সনদ (১৯৪৯) এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- “প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা জ্ঞাপন করার অধিকার”।

বাকস্বাধীনতা হচ্ছে স্বতন্ত্র্য ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের; নির্ভয়ে, বিনা প্রহরতায় বা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা, অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যতা ব্যতিরেকে নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার সমর্থিত মুলনীতি।[২][৩][৪][৫] “মত প্রকাশের স্বাধীনতা” (freedom of expression) শব্দপুঞ্জটিকেও কখনও কখনও বাকস্বাধীনতার স্থলে ব্যবহার করা হয়, তবে এক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার সাথে মাধ্যম নির্বিশেষে তথ্য বা ধারণার অন্বেষণ, গ্রহণ এবং প্রদান সম্পর্কিত যেকোন কার্যের অধিকারকেও বুঝিয়ে থাকে।

দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি। সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি? জীবনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে দিলে হয়তো ভ্রান্তিকে ঠেকানো যায়, কিন্তু সত্যকে পাওয়া যায় না। আকরিক ধাতু যেমন মটির সাথে মিশে থাকে, মাটি পরিস্কার করে তাকে পেতে হয়, জীবনের পথেও তেমনি সত্য ও মিথ্যা মিলে আছে। জীবন-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এজন্য কাঙ্ক্ষিত হিরন্ময় সত্য উদ্ঘাটনে বাস্তবের কঠিন ও দুর্গম পথে প্রয়োজন নিঃশঙ্ক দীপ্ত পদচারণা।

করোনাভাইরাস সঙ্কটের এই সময়ে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য সম্বলিত পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সরকারি কর্মচারীদের অনুসরণীয় কয়েকটা বিষয় ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো …

সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী কোনো রকম তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিপন্থি কোন তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে এমন কোন পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোন সার্ভিস/পেশাকে হেয়প্রতিপন্ন করে এমন কোন পোস্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

লিঙ্গ বৈষম্য বা এ সংক্রান্ত বিতর্কমূলক কোন তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না।

জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন বিষয় লেখা, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

ভিত্তিহীন, অসত্য ও অশ্লীল তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।

অন্য কোন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য সম্বলিত পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক ও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কনটেন্ট ও বন্ধু নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সতর্কতা অবলম্বন এবং অপ্রয়োজনীয় ট্যাগ, রেফারেন্স বা শেয়ার করা পরিহার করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পরিপত্রে বলা হয়েছে, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার বা নিজ একাউন্টের ক্ষতিকারক কনটেন্টের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা /কর্মচারী ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হবেন এবং এজন্য প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়ে নির্দেশনা জারি করেছিলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর বিভিন্ন সময় ওই নির্দেশনা পরিমার্জন করা হয়।

সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০১৯ (পরিমার্জিত সংস্করণ)’ অনুসরণ করা নিয়ে বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রে এই হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে সংকট। শুধু সংখ্যার হিসেবে নয় করোনা আতঙ্কে সত্যিকার অর্থেই কাঁপছে বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। যেকোন মহাযুদ্ধের চেয়েও বড় কঠিন এই যুদ্ধ। কলি যুগে দুষ্টের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিলে। মানুষের কষ্ট বেড়েছিল। বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষে তৃতীয়া তিথিতে সত্যযুগের উৎপত্তি। এখন আমাদের এই সত্যযুগে যেতে হবে। এখানে সবাই একজন যোদ্ধা। সত্যের প্রশ্নে ন্যায্যতার পক্ষে মানবতার পক্ষে সাম্যের পক্ষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাঁচতে হলে সত্যিটা বলতেই হবে।

করোনাভাইরাস বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগের বিষয়। এই ভাইরাস সমাজে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যা জনজীবনে আতঙ্ক ও অস্বস্তিতে পরিণত হয়েছে। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দেশে বিদেশে বেড়েই চলেছে। যা আমাদের মত দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই ভাইরাসের প্রভাব সর্বস্তরে যেমন অর্থনীতি, রাজনীতি, ক্রীড়াঙ্গন, ট্যুরিজম, দাম্পত্য জীবন, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানী-রপ্তানী, উৎসব উদযাপন এবং বিনোদন জগত সর্বত্রই বিরাজমান।

গত ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে করোনাভাইরাসের আক্রমণ মোকাবেলা করাকে একটি যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে বলেন -এই যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা দরকার। তিনি আরও বলেন, ‘বাঙালী বীরের জাতি। নানা দুর্যোগে-সঙ্কটে বাঙালি জাতি সম্মিলিতভাবে সেগুলো মোকাবিলা করেছে। ১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা শত্রুর মোকাবেলা করে বিজয়ী হয়েছি। এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।’

বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই এখন একটি যুদ্ধ মোকাবেলা করছে। ’৭১-এর মার্চের মতই বাংলাদেশ এই যুদ্ধ শুরু করেছে এই মার্চেই, সেবারের যুদ্ধে আমাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর এবারের যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হবে সেসব মোকাবেলায় আমাদের সম্মিলিত ঐক্য ধরে রাখতে হবে। এই কঠিন দু:সময়ে কোন বিভাজন কিছুতেই কাম্য নয়।

যে তোমার দোষ ধরে বন্ধু সেই জন। মন্দকে মন্দ আর ভালোকে ভালো বললেই হবে। প্রজ্ঞাপন দিয়ে তো বিবেককে বেঁধে রাখা যায় না। সরকার আর রাষ্ট্র কিন্তু এক নয়। সরকার আসবে যাবে কিন্তু রাষ্ট্রকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে কিসে তার জনগণের মঙ্গল নিহিত। শুধু ভাবলেই হবে না, সেটা রাষ্ট্রকেই আবার নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রকে শত্রু এবং মিত্র চিনতে হবে। প্রকৃত বন্ধু তো সেইজন যে ভুল ধরিয়ে দেয়। জুজুর ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ না করিয়ে রেখে বরং গঠনমূলক সমালোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক। তাতেই জনগণ এবং রাষ্ট্রের প্রকৃত কল্যাণ।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *