দীর্ঘ হচ্ছে দুদকের অনুসন্ধান তালিকা বেশির ভাগই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শুদ্ধি অভিযানের পর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ প্রভাবশালী অনেকের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) । আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কিছুটা স্থিমিত হলেও দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে জোরেশোরেই। ক্রমশই সংস্থাটির অনুসন্ধান টেবিলে যোগ হচ্ছে একের পর এক নাম। যাদের মধ্যে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকেই রয়েছেন। শুরুর দিকে ৪৯ জন নিয়ে শুরু হওয়া এই তালিকা এখন ১৮৭ জনে ঠেকেছে। দুদক জানিয়েছে, শুদ্ধি অভিযান তথা সরকার ঘোষিত ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে বিশেষ এই অনুসন্ধান কার্যক্রম।

ক্যাসিনোসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক। সংস্থাটির অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ হওয়া এই তালিকায় সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের নামই বেশি রয়েছে।
দুদকের মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান জানিয়েছেন, আগের ১৫৯ জনের অবৈধ সম্পদের বিষয়টি আগেই অনুসন্ধান দলের হাতে ছিল। এর মধ্যে নতুন করে ২৮ জনের নাম যুক্ত হওয়ায় তালিকাটি ১৮৭ জনের হয়েছে। দুদকের এই কর্মকর্তা কারো নাম উল্লেখ না করলেও সূত্র জানায়, নতুনদের মধ্যে নাম রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম এবং একই সংগঠন থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সদ্য বাদ পড়া সভাপতি রেজওয়ানুল হক শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর নাম। দুদক সূত্র জানায়, এ তালিকায় আরো নাম রয়েছে-স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. কাওছার, ব্যবসায়ী বনানী গোল্ড ক্লাবের সদস্য আবদুল আওয়াল ও আবুল কাশেম, ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাশেদুল হক ভূইয়া, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাতেনুল হক ভূইয়া, শিক্ষা অধিদপ্তরের ঠিকাদার মো. শফিকুল ইসলামের। এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি সরোয়ার হোসেন মনা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন স্বপন, নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের নাম রয়েছে নতুন তালিকায়।

অন্যদিকে আরো যুক্ত হয়েছেন বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও। তাদের মধ্যে ওমানে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী নাদিম ও দুবাইয়ে থাকা জিসান। এছাড়া মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির জাকির, নয়াটোলার সেন্টু ও শোভন এবং বাড্ডার নাসিরের নামও রয়েছে এই তালিকায়। পাশাপাশি গণপূর্ত অধিদপ্তর ও জাতীয় গৃহায়ন অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও একাধিক ঠিকাদারের নাম রয়েছে বলে দুদকের সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। তালিকা শুরুর দিকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সামশুল হক চৌধুরী ও মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের নাম ছিল।

গত ১৭ই নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১০৫ জনের ব্যাংক হিসাব তলব করে দুদক। ওই দিন ব্যাংকটির ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান বরাবর একটি চিঠিতে তাদের নাম, ঠিকানা সব উল্লেখ করে ব্যাংকিং তথ্য চান দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। সূত্র জানায়, যে ১০৫ জনের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয় তাদের বিরুদ্ধেই অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান। যাদের ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে তারা হলেন- যুবলীগের আগের কমিটির বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুইয়া, সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান, টেন্ডার মুঘল জিকে শামীম, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনু, যুগ্ম সম্পাদক রূপন চৌধুরী, ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাশেদুল হক ভুইয়া, ৪১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাতেনুল হক ভুইয়া, মো. জহুর আলম, হারুনুর রশিদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা মোমিনুল হক সাঈদ, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ, যুবলীগের বহিস্কৃত দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান আনিস, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারিকুজ্জামান রাজিব, মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভুইয়া, অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান। এ ছাড়াও রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এমপি পংকজ দেবনাথ, এমপি নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী, সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী এমপি, কমলাপুর আইসিডি’র কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত কমিশনার মো. মাহমুদুল হাসান, সহকারী কমিশনার কানিজ ফারহানা শিমু, আবুল কাশেম, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা তুহিনুল হক, ঢাকা দক্ষিণ ২০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ওরফে ম্যাজিক রতন, ৩৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মঈনুল হক মঞ্জু। তালিকায় আরো রয়েছেন- গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন, রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎফল কুমার দে, আবদুল হাই, হাফিজুর রহমান মুন্সী, নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল হক মধূ, শওকত উল্লাহ, ফজলুল হক, রোকন উদ্দিন, আফসার উদ্দিন, স্বপন চাকমা, ইলিয়াস আহমেদ ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল মোমিন চৌধুরী, সাজ্জাদ, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র সহকারী প্রধান মুমিতুর রহমান, উপসহকারী প্রকৌশলী আলী আকবর সরকার, যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি সারোয়ার হোসেন মনা, যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন স্বপন, নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, মিজানুর রহমান মিজান, ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সভাপতি এসএম রবিউল ইসলাম সোহেল, যুবলীগ নাখাল পাড়া-তেজগাঁও শাখার কাজল, মেসার্স জামাল এন্ড কোং এর ঠিকাদার জামাল হোসেন, আফসার উদ্দিন মাস্টার, আয়েশা আক্তার, শামীমা সুলতানা, শেখ মাহাম্মুদ জুনায়েদ, এসএম আজমুল হোসেন, ব্রজ গোপাল হালদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে প্রশান্ত কুমার হালদার, শরফুল আওয়াল, শিক্ষা অধিদপ্তরের ঠিকাদার শফিকুল ইসলাম, পদ্মা এসোসিয়েটস ইঞ্জিনিয়ার্সের ঠিকাদার মিনারুল চাকলাদার, সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, যুবলীগের গাজী সারোয়ার বাবু, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের ঠিকাদার রেজোয়ান মোস্তাফিজ, বান্দরবানের সিলভান ওয়াই রিসোর্ট এন্ড স্পা সেন্টারের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন মন্টু, এমডি ফজলুল করিম চৌধুরী স্বপন, পরিচালক এম মহসিন, উম্মে হাবিবা নাসিমা আক্তার, জিয়া উদ্দিন আবীর, জাওয়াদ উদ্দিন, জিকে শামীমের সহযোগী জিয়া, নাঈম, ৪১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তাবিবুল হক তামিম, শাহেদুল হক, তার স্ত্রী সারিনা তামান্না হক, স্বেচ্ছা সেবক লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক কেএম মাসুদুর রহমান, তার স্ত্রী লুৎফুন্নাহার লুনা, বাবা আবুল খায়ের খান, মা রাজিয়া খান, যুব লীগ দক্ষিণের সহসভাপতি মুরসালিক আহমেদ, তার স্ত্রী কাওসারী আজাদ, বাবা আবদুল লতিফ, মা আছিয়া বেগম, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা কামরান প্রিন্স মোহাব্বত, যুবলীগের আকিয়ার রহমান দীপু, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান হোসেন খান, কেন্দ্রীয় সদস্য হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শফিক, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক তসলিম উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক কায়সার আহমেদ, যুবলীগ উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজুল ইসলাম
চৌধুরী বাপ্পী, খাদ্য পরিদর্শক খোরশেদ আলম।

প্রসঙ্গত, গত ১৮ই সেপ্টেম্বর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু করে। প্রথম দিনেই রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে অভিযান চালিয়ে শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করে। এরপরই একের পর এক প্রভাশালীদের আইনের আওতায় আনা হয়। তার কিছুদিন পর ৩০শে সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সংস্থাটির পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল অনুসন্ধানে নামে। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২ মাসেরও বেশি সময়ে দুদক একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি করে কাজ করছে। এরই মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ১৬টি মামলা করেছে সংস্থাটি। যার মধ্যে আসামি হয়েছেন ১৯ জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *