পিয়াজে স্বস্তি মিলবে কবে?

Slider অর্থ ও বাণিজ্য টপ নিউজ ফুলজান বিবির বাংলা


বলা হচ্ছিল ডিসেম্বরের শুরুতেই পিয়াজের দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পার হলেও একটুও কমেনি পিয়াজের দামের উত্তাপ। এখনো দেশি পিয়াজের কেজি ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা । আমদানি করা পিয়াজের দামও দেড়শ থেকে ২০০টাকার উপরে। বাজারে আসা নতুন মুল কাটা পিয়াজের দামও ২০০টাকা কেজি। প্রায় দুই মাস ধরে চলছে এমন পরিস্থিতি। এ অবস্থায় সাধারণ ক্রেতারা পড়েছেন মহা অস্বস্তিতে। কবে দাম কমবে এরও কোন নিশ্চয়তা মিলছে না।

বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত বাজারে এর কোন প্রভাব নেই। রাজধানীর খুচরা বাজারে বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকায়। এছাড়া আমদানি করা মিয়ানমারের পিয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। ফলে বাজারে আসা ভোক্তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে দেশি পুরনো পিয়াজ প্রতিকেজি ২৬০ থেকে ২৭০, নতুন পিয়াজ ১৯০ থেকে ২০০, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পিয়াজ ২২০ থেকে ২৩০, চীন থেকে আনা পিয়াজ ১২০ থেকে ১৩০ ও মিসরীয় পিয়াজ ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার মূল্য তালিকায় দেখা গেছে, গত এক মাসে আমদানি করা পিয়াজের মূল্য বেড়েছে ৩২ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে এই পিয়াজের মূল্য বেড়েছে ৫২০ শতাংশ। অন্যদিকে এক মাসের ব্যবধানে দেশি পিয়াজের মূল্য বেড়েছে ৯১.৮৪ শতাংশ। আর এক বছরের ব্যবধানে এই পিয়াজের মূল্য বেড়েছে ৬২৩ শতাংশ।

টিসিবি বলছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশি পিয়াজের মূল্য ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এক বছর পরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি দরে। তবে, রাজধানীর বাজারগুলোতে এরচেয়েও বেশি মূল্যে পিয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেছে। দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৬০ টাকা কেজি দরে। ভালো পিয়াজ (দেশি) ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পিয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে দৈনিক ৩ হাজার টন পিয়াজের সরবরাহ প্রয়োজন। প্রতিদিন যদি অন্তত ১ থেকে দেড় হাজার টন পিয়াজ বাজারে প্রবেশ করে, তাহলেও ১০০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে পিয়াজ বিক্রি করা যাবে। মিশর-তুরস্ক বা আরব আমিরাত থেকে জাহাজে করে পিয়াজ এনে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রির সুযোগ নেই। কিন্তু প্রতিদিন তো ১ হাজার টন পিয়াজও বাজারে আসছে না। ৭ থেকে ৮০০ টন বাজারে আসছে। আবার জাহাজে একদিন পিয়াজ আসে, চার দিন পর আসে আরেক জাহাজ। ৪০০ টন, ৫০০ টন করে একদিন পিয়াজ ঢুকল, এরপর তিন দিন দেখা নেই, এভাবে বাজার স্বাভাবিক হবে না। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভারতের মহারাষ্ট্রে উৎপাদিত নতুন পিয়াজ উঠবে। তখন ভারত রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে। তখন দাম স্বাভাবিক হতে পারে। আর জানুয়ারি থেকে পুরোদমে দেশের পিয়াজ উঠতে শুরু করলে এমনিতে কমে আসবে।
২৯শে সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি বন্ধের পর থেকে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে পিয়াজ আমদানি হয়েছে ৬৮ হাজার টন। অথচ আমদানি স্বাভাবিক থাকলে এই দুই মাসে দেশের বাজারে পিয়াজ আসত কমপক্ষে ২ লাখ টন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাপক চাহিদা এবং অধিক মূল্য বিবেচনায় বাজারে সরবরাহ বাড়াতে আগাম পিয়াজ তুলছেন কৃষকরা। এই পিয়াজ এলেও বাজারে দাম কমাতে পারেনি। উল্টো নতুন এ পিয়াজের দাম বেড়ে গেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন পিয়াজের দাম কেজিতে ৫০ টাকা বেড়েছে। দেশীয় পুরোনো পিয়াজের দাম কেজিতে আরো ২০ টাকা বেড়েছে।

এদিকে শুক্রবার রাজধানীতে কৃষকের বাজার উদ্বোধনকালে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, বাড়তি দামের কারণে কৃষকদের অপরিপক্ব পিয়াজ তুলে ফেলায় সরকার উদ্বিগ্ন। আমরা এটা নিয়ে শঙ্কিত। সব ছোট ছোট পিয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছে। জানুয়ারি মাসে কী উপায় হবে? পিয়াজের উৎপাদন তো কমে যাবে। এ বছর পিয়াজের দাম বেশি থাকায় আগামী বছর দেশে অনেক বেশি পিয়াজ উৎপাদন হতে পারে। এতে কৃষক পরবর্তী বছর পিয়াজের ন্যায্যমূল্য পাবেন কি না, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার ও রামপুরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমদানি করা পিয়াজের মধ্যে মিয়ানমারের পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকা কেজি। যা বৃহস্পতিবার বিক্রি হয় ২০০-২১০ টাকায়। মিসরের পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৫০-১৬০ টাকা কেজি। আর চীন থেকে আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা কেজি। এছাড়া বাজারে প্রতি কেজি দেশি নতুন পিয়াজ (মুড়িকাটা) বিক্রি হয়েছে ১৫০-১৮০ টাকায়।
রাজধানীর পাইকারি আড়ত শ্যামবাজার বিক্রেতারা জানান, পাইকারি প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৪০-২৫০ টাকায়। যা বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ২৩৫-২৪০ টাকায়। মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পিয়াজ ১৭০-১৮০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১১০ টাকা।

কাওরান বাজারে আসা মানিক বলেন, প্রতিদিনই পিয়াজের দাম বাড়ছে। এটা কি করে হয়! বিক্রেতারা বলছেন, ঘাটতি আছে। কিন্তু বাজারে বেশি দাম দিলে চাহিদামতোই কিনতে পারছি। ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের জিম্মিদশা থেকে বের করার মতো কেউ নেই।
সূত্র জানায়, দেশে বছরে পিয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন বলে ধরা হয়। প্রতি মাসে গড় চাহিদা ২ লাখ টন। দৈনিক চাহিদা ৭ হাজার টনের কিছু কম। আর টিসিবির ৫০টি ট্রাকে প্রতিদিন ১ টন করে ৫০ টন পিয়াজ খোলাবাজারে প্রতি কেজি ৪৫ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। ৭ হাজার টনের বিপরীতে ৫০ টন পিয়াজ বাজারে প্রভাব ফেলতে পারছে না। তবে এটা শহুরে নিম্নবিত্তদের জন্য, সারাদেশে বা গ্রামের মানুষের জন্য নয়।

কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, গেল বছর (২০১৮-১৯ অর্থবছর) দেশে পিয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন। কিন্তু এই উৎপাদিত পিয়াজের প্রায় ৩০ ভাগ নষ্ট হয়। ফলে বছরে ২৪ লাখ টন পেয়াজের চাহিদার বিপরীতে ৮ থেকে ৯ লাখ টন পিয়াজের ঘাটতি থাকে। তাই অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পিয়াজ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পিয়াজ আমদানি হয়েছে ২২ লাখ টন। নতুন অর্থ বছরে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পিয়াজ আমদানি করা হয়েছে ৪ লাখ ৭২ হাজার টন।

এদিকে শুক্রবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ৫ই ডিসেম্বর দেশে ৪১৫৯ টন পিয়াজ আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফ হয়ে দেশে এসেছে ১২২৭ টন পিয়াজ এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর হয়ে এসেছে ২৯৩২ টন পিয়াজ। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে ১২২৭ টন, চীন থেকে ৩৮৪ টন, মিসর থেকে ৮৪ টন ও তুরস্ক থেকে ২৫০০ টন পিয়াজ আমদানি করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত অর্থবছরে আমদানি ও দেশীয় উৎপাদন মিলে দেশের বাজারে প্রতিদিন পিয়াজের সরবরাহ ছিল ৭ হাজার টনেরও বেশি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়। একপর্যায়ে এই সরবরাহ ৫০০ টনের মধ্যে চলে আসে। পিয়াজের দাম কেজিতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় গিয়ে পৌঁছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় পিয়াজের চাহিদাও নেমে আসে অর্ধেকে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে মূল্য বাড়বেই। নতুন পিয়াজ উঠলে কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু নতুন পিয়াজ আসার পরও যদি মূল্য না কমে, তাহলে হয়তো কিছুই বলার থাকবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *