বনখেকো জসিমের লাশ বনের জায়গায় দাফন করতে দেয়নি এলাকাবাসী

Slider টপ নিউজ

গাজীপুর: গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বনখেকো, ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী জসীম ইকবালের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেল গভীর বনের ভেতরেই। মাথা, বুক আর হাতের বাহুতে রয়েছে গুলির চিহ্ন। লাশের পাশে পড়ে ছিল রক্তাক্ত একটি বিদেশি পিস্তলও। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ভুলেশ্বর নেতারটেক এলাকার গভীর বন থেকে গতকাল শুক্রবার ভোরের দিকে ১৬টি মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি জসীমের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে কালিয়াকৈরবাসীর আতঙ্ক জসীমের লাশ হস্তান্তর করা হয়। তবে বন বিভাগের জায়গায় তার কবর খোঁড়া হলেও বন বিভাগ ও স্থানীয়দের বাধায় তাকে দাফন করা যায়নি। তার লাশ গতকাল রাতে কিশোরগঞ্জে নিজ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে কালিয়াকৈরের চন্দ্রার জোড়া পাম্প এলাকা থেকে জসীমকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একদল যুবক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় বলে দাবি করেছিল তার পরিবার। তবে জেলা গোয়েন্দা শাখা পুলিশের ওসি আমির হোসেন পরিবারের দাবি অসত্য উল্লেখ করে বলেন, ডিবি পুলিশের কোনো সদস্যের হাতে জসীম গ্রেফতার হয়নি। তা ছাড়া ডিবি পুলিশের কোনো টিম ওই দিন কালিয়াকৈরে অভিযানেও যায়নি।

জসীমের সহযোগী এ বি সিদ্দিক বাবু বলেন, স্থানীয় দোকানিরা দেখেছেন কালো রঙের একটি মাইক্রোবাসে জসীমকে তুলে নিয়ে গেছে অজ্ঞাতরা। গাড়ির সামনে ডিবি পুলিশ লেখা একটি স্টিকার ছিল।

বনের ৩০০ বিঘা জায়গা দখল করে নতুনপাড়া নামের গ্রাম গড়ে তোলার মূল হোতা জসীমকে গ্রেফতারের খবরে রাতেই হাজার হাজার মানুষ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে নেমে আনন্দ মিছিল করে। পাড়া-মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

কাপাসিয়া থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান, এসআই সুমনের নেতৃত্বে কয়েক পুলিশ সদস্য রাতে নিয়মিত টহল দিচ্ছিলেন। রাত পৌনে ৩টার দিকে টহলরত অবস্থায় হঠাৎ ভুলেশ্বর এলাকার বনের ভেতর থেকে তারা গুলির শব্দ শুনতে পান। পরে ঘটনাস্থলে রক্তাক্ত এক যুবকের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার পাশে বিদেশি একটি পিস্তলও ছিল। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

ওসি বলেন, গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ছায়া বেগম মর্গে এসে লাশ শনাক্ত করেন। পরে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক প্রণয় ভূষণ দাস বলেন, তার মাথা, বুক ও বাহুতে গুলির চিহ্ন রয়েছে।

ওসি আবু বকর জানান, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা ও অস্ত্র আইনে অজ্ঞাত আসামি করে পৃথক দুটি মামলা করেছে। দুই দল সন্ত্রাসীর গুলিবিনিময়ের সময় তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা পুলিশের।

কে এই জসীম

কালিয়াকৈর চন্দ্রা এলাকায় হাজারো মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কের নাম ছিল জসীম। মাত্র চার-পাঁচ বছরের মধ্যে জসীম বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হন। গড়ে তোলেন বিলাসবহুল বহুতল ভবন, গাড়ি, মার্কেট, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা মূল্যের জমি। তার নামে ১৬টি মামলায় রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা, দুটিতে ছয় মাস করে সাজা। অপ্রতিরোধ্য জসীমের কর্মকাণ্ডের কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নেমে আসত অত্যাচার। তার কুকর্মের প্রতিবাদ করে অসংখ্য নিরীহ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট জসীমের ছিল শক্তিশালী একটি ক্যাডার বাহিনী। উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় বনের অন্তত ৩০০ বিঘা জমি দখল করেন তিনি।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে জসীম ১৫-২০ বছর আগে কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকায় এসে একটি জুতা কারখানায় পিয়ন পদে চাকরি নেন। এর আগে টোকাইয়ের কাজও করতেন তিনি। কখনও ছিলেন রাজমিস্ত্রির জোগালি। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই জুতা বানিয়ে ওই কোম্পানিতে সরবরাহ করতে শুরু করেন। এ কারণে এলাকায় তিনি ‘মুচি জসীম’ নামেও পরিচিতি লাভ করেন। তার প্রথম স্ত্রীর পাঁচ মেয়ে আর দ্বিতীয় স্ত্রীর এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

২০১৫ সালের ২১ আগস্ট চন্দ্রায় জাতির পিতা কলেজ মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কালিয়াকৈর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলামকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ মামলায় পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতে গিয়ে জসীমের উত্থান। চন্দ্রার জোড়া পাম্প এলাকায় গজারি গাছ কেটে ২৬১ বিঘা জমির বেশিরভাগই জবরদখল করে ‘নতুনপাড়া’ নামে একটি গ্রাম গড়ে তোলেন তিনি। অথচ বছর তিন-চার আগেও ওই এলাকাটি ছিল শাল-গজারির গভীর অরণ্যে ঘেরা। রাতারাতি পুরো বনাঞ্চল বিরানভূমিতে পরিণত করে গড়ে তোলা হয় নতুনপাড়া। প্রায় ৩০০ পরিবারের কাছ থেকে ৩-৫ লাখ করে টাকা নিয়ে সেখানে প্লট বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হন তিনি। পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যের মূল সোর্স ছিলেন জসীম। নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে টাকা আদায় করা ছিল জসীমের কাজ। বনের জমি দখল করে নিজের মায়ের নামে মসজিদও বানিয়েছেন তিনি। সেই ভূমিতে তার মাকে কবরও দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বন বিভাগের জমিতে ওই মসজিদ নির্মাণ নিয়ে সংঘর্ষ হয়। বাধা দেওয়ায় চন্দ্রা বন অফিসের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালায় জসীমের লোকজন। বন কর্মকর্তারা ৯ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

অসংখ্য নিরীহ মানুষের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, পরিবহনে চাঁদাবাজি, চুক্তির মাধ্যমে অন্যের জমি দখল করা- এসব ছিল জসীমের কাজ।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, জবরদখল হয়ে যাওয়া বন বিভাগের ৩০০ বিঘা জমি উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করা হবে। কোনোভাবেই সরকারি জমি ব্যক্তির দখলে থাকতে দেওয়া হবে না।

জসীমের রাজত্ব নিয়ে বুধবার সমকালে ‘বনের জায়গায় জসীমের গ্রাম’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *