পরে মরদেহের পকেট থেকে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করে পুলিশ জানায়, মৃত ব্যক্তি ঝন্টু দাশ।
কিছুক্ষণ পর ‘আমার ঝন্টুদা কোথায়…’ বলতে বলতে ছুটে আসেন টিংকু দাশ নামের আরও একজন। ‘ওই তো লাশ’ বলে স্তব্ধ হয়ে গেলেন মরদেহের সামনে। পুলিশ ও গণমাধ্যমের কর্মীরা ধাঁধায় পড়ে যান তখন। যতই টিংকুকে বলা হচ্ছিল ‘ওই লাশ ঝন্টুর না, পাশের লাশটির পকেট থেকে ঝন্টু দাশের পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে।’ তখন কান্না আর ক্রোধমাখা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে কি আমি চিনব না?’
ততক্ষণে পাশের যুবকটির কান্না কিছুটা থেমেছে। জানতে চাইতেই বললেন, তাঁর ভাইয়ের নাম লিটন দেব। তাঁর নাম ঝুটন দেব। হাজারি গলির ওষুধের দোকানি লিটনকে নিয়তি রীমা কনভেনশন সেন্টারে নিয়ে গেছে বলে কাঁদতে কাঁদতে জানান তিনি।
গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম নগরের রীমা কনভেনশন সেন্টারে পদদলিত হয়ে এ দুজনসহ ১০ জন মারা যান। লাশগুলো রাখা হয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের লাশঘরের সামনে। এত লাশ রাখার জায়গা ছিল না এখানে।
এক-একজন স্বজন এসে লাশ শনাক্ত করছিলেন, আর বুকফাটা আর্তনাদ করছিলেন। নগরের গোসাইলডাঙ্গার বাসিন্দা ঠিকাদার প্রদীপ তালুকদার গত রোববার বান্দরবান থেকে বাসায় ফেরেন। তিনি ব্যবসার কাজে সেখানে গিয়েছিলেন। গতকাল বাসায় কাউকে কিছু না বলে তিনিও রীমায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির মেজবানে যান।
‘আমাদের কাউকে কিছু বলেনি। বলেছে বিদ্যুতের বিল দিতে বের হচ্ছে। পরে ফোনে তাকে আর পাই না। দুইটার পর একটি ফোন আসে।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী রেখা তালুকদার।
প্রদীপের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে রিপা তালুকদার এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট মেয়ে রিয়া অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। দুই মেয়ের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতালের লাশঘরের পরিবেশ। রিপা বারবার বলতে থাকে, ‘কেন ওখানে গিয়েছ বাবা?’
নগরের লাভ লেনে একটি সেলুন চালান ধনা চন্দ্র শীল। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে তিনিও যান মেজবানে। এরপর আর কোনো খোঁজ ছিল না। তাঁর মামাতো ভাই রূপন সুশীল ফেসবুকে নিহত ব্যক্তিদের ছবির মধ্যে ভাই ধনা চন্দ্রকে খুঁজে পান। এরপর রূপন তাঁর ভাই ধনা চন্দ্রের মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। ফোন ধরে পুলিশ ধনার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর পরিবারের সদস্যরা ছুটে আসেন হাসপাতালে।
‘ও ভাই, ও ভাই তুই কই গেলি? আমারে ছেড়ে গেলি, কই গেলি? আমার ভাইরে একটু দেখাও।’—হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বিলাপ করছিলেন সুনীল দাস। পরে তাঁর বড় ভাই সুধীরের দেখা ঠিকই পান তিনি। কিন্তু প্রাণহীন ভাইকে জড়িয়ে ধরে শুধু বিলাপ করে গেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষার্থী দীপঙ্কর দাশ ওরফে রাহুলকেও যেন মৃত্যু টেনে নিয়ে গেছে রীমা কনভেনশন সেন্টারে। প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্য ছিলেন দীপঙ্কর। তাঁর মৃত্যুতে শিক্ষক ও সহপাঠীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি ও আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আহসান খালিদ বলেন, ‘গত শনিবারও বিজয় দিবসে বন্ধুসভার পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে রাহুল ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে যায়। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। এখন সে নেই। মানা যায় না এটা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সভাপতি মোহাম্মদ মাহবুবুল হক বলেন, ‘দুঃখজনক একটি ঘটনা। কদিন আগে রাহুলের তৃতীয় বর্ষের মৌখিক পরীক্ষা নিলাম। এখন সে নেই।’
কৃষ্ণপদ দাসের স্বজনেরা এত শোক কীভাবে সইবেন! এক মাস দুই দিন আগে কৃষ্ণপদ দাসের মা সীতারানী দাস মারা যান। দুই দিন আগে মায়ের পারলৌকিক ক্রিয়া করেন কৃষ্ণপদ। গতকাল তিনি পদদলিত হয়ে মারা যান।
ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন বোন সাগরিকা দাস। জরুরি বিভাগের ফটকের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন তিনি। বলেন, ‘অ ভাই, সুখে-দুখে আমরা ছিলাম। মা চলে গেল। তুইও চলে গেলি। ভাইরে কেন তুই মেজবানে গেলি।’