সময়ের হিসাবে বাংলাদেশের বয়স প্রায় পাঁচ দশক হতে চলেছে। ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে এ খুব দীর্ঘ সময় নয়। ব্যক্তির ইতিহাস আর রাষ্ট্রের ইতিহাস পাশাপাশি এক রেখায় চলে না। রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী। একটি রাষ্ট্রের পেছনে হাজার বছরের ইতিহাস থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যে নির্দিষ্ট অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলছি, তা তো মাত্র ৪৬ বছর আগের অর্জন।
বিজয়ের এই মুহূর্তে পেছন ফিরে নিরাসক্তভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে, গাঙ্গেয় বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্জন নেহাত কম নয়। নানা দিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। বাংলাদেশের বিশাল কর্মযজ্ঞের নানা দিকের স্বীকৃতিও বিশ্বের মানুষ দিচ্ছে। কিন্তু কথা তারপরও থাকে। সাধারণ মানুষ বলতেই পারে, অন্যের মুখে ঝাল খেলে কী তার স্বাদ, সেটি কখনোই বোঝা যায় না। নিশ্চয় আমরা এ কথাও বলব, সাধারণ মানুষ, যাদের বলা হয় আমজনতা, তারা এসব উন্নয়ন চাক্ষুষ করেছে বটে, তবে তা সরাসরি তাদের জীবনের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে যে যুক্ত হয়েছে বা হচ্ছে, এমনটি বলা যাবে না। এসব কারণেই বঙ্গীয় লোককথায় বলা হয়, ‘যত গর্জে, তত বর্ষে না।’
সমাজের ওপরতলার মানুষ বলবে, কোথাও কোনো দুর্যোগ নেই। কিন্তু দেশের ১৭ কোটি মানুষের ৯০ ভাগই এ কথা বলবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের সমগ্র সম্পদের বণ্টন ও ব্যবহার এখনো অল্পসংখ্যক মানুষেরই করতলগত। দারিদ্র্য নেই অথবা দুমুঠো ভাতের অভাব নেই, এ কথায় শাসকদের আত্মবিশ্বাস বাড়তে পারে, তাঁরা প্রশান্তিও লাভ করতে পারেন, তবে বিষমবৈষম্যের তাতে কোনো হেরফের হয় না। আবার দুমুঠো ভাতই তো মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, সামাজিক অবস্থান প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে আমাদের এই সমাজে বিত্ত ও সম্পদের বৈষম্যের কারণে বিস্তর ব্যবধান আজও রয়েছে। তাই মাথাপিছু রোজগার বেড়েছে বললে আদতে তেমন কিছু বোঝা যায় না। গড় আয় যদি ১০ ভাগ হয়ে থাকে, জনগণ তার দুই ভাগের বেশি মালিক হতে পারে কি? পারে না। শেষ অব্দি বাকি আট ভাগ মুষ্টিমেয়র হাতেই থাকে, থাকছে। মূলত এ জন্যই দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্জনে অধিকাংশ মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও সেটি ভোগ করছে কেবল উঁচু শ্রেণির মানুষ। এদিক থেকে হিসাব করলে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের গলাবাজি করতে আমাদের একটু লজ্জা হওয়ারই কথা। এই কথাগুলো যে মনগড়া নয়, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তা বোঝা যাবে।
এই বাংলাদেশ বহু মানুষের রক্তে কেনা। কেবল মাতৃভাষাকে অবলম্বন করে এ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। তা-ও সমগ্র পৃথিবীর সামনে এক অনন্য সাধারণ অর্জন। সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায়, প্রকৃতপক্ষে আমরাই তার মালিক। পলিমাটিময় এই দেশের মাটি অকল্পনীয়ভাবে উর্বর। এ দেশের প্রকৃতি স্নিগ্ধ, নয়নাভিরাম। মানবসম্পদও আমাদের বড় সম্পদ। সব মিলিয়ে শত সম্পদে ভরা বাংলাদেশ বিপুল বৈচিত্র্যে সাজানো। তাই কবির কথাটি মানতেই হয়, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’। তবে ইতিহাসের নিরিখে বিশেষ করে এই কথাটিও বলতে হবে, বাংলাদেশ নামের এই বসুন্ধরায় জনগণমুখী শাসন ছাড়া কোনো রকম রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্য মানুষ মেনে নেয়নি, কখনো নেবেও না।
ড. এ কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম