১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের অন্যান্য জায়গার মতো নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই জেলায় প্রায় ২২টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। আজও সেই গণকবরগুলো পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। সংস্কার বা সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
একটি হলো নরসিংদীর পাঁচদোনা গণকবর। এ জেলার সবচেয়ে বড় গণকবর এটি। পাঁচদোনা গণকবরের কিছুটা অংশের ওপর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। সেতুর ঠিক সামনেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। এখানে আশপাশের গ্রাম থেকে নারীদের ধরে আনা হতো। আটকে রেখে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। আর ধরে আনা তরুণদের ক্যাম্পে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হতো, মরদেহ এখানে গণকবর দেওয়া হতো। এমনকি যুদ্ধ চলাকালে এই সড়কে চলাচলকারী যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের হত্যার পর গণকবর দেওয়া হতো।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন, একাত্তরের ১২ ডিসেম্বরে পাঁচদোনা সেতুর কাছে প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ শেষে ২১ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্য আত্মসমর্পণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন জনতাকে সঙ্গে নিয়ে জয় বাংলা স্লোগানে পাঁচদোনা সেতু থেকে নরসিংদী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আনন্দ মিছিল করেন।
উল্লেখযোগ্য অন্য গণকবরগুলো হলো শিলমান্দি মাছিমপুর বিল, খাটেহারা সেতু, মনোহরদীর ব্রহ্মপুত্র নদের তীর, শিবপুরে ঘাসিরদিয়া, বেলাব আড়িয়াল খাঁ নদীর পাশে ও রায়পুরা মেথিকান্দা রেলস্টেশনের গণকবর। ছোট-বড় প্রায় ২২টি গণকবর আজও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার সাক্ষ্য বহন করছে। কোনো কোনো গণকবরে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। কোথাও শুধু ভিত্তিপ্রস্তরেই থমকে আছে স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ।
পাঁচদোনা সেতু-সংলগ্ন গণকবরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা পবিত্র রঞ্জন দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পাঁচদোনা সেতুর সামনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা এখানে শত শত মানুষের লাশ ও কঙ্কাল পেয়েছি। বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে নারীদের ধরে এনে এখানে আটকে রাখা হতো। তাঁদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো। তরুণ ও যুবকদের ধরে এনে এখানে হত্যা করা হতো।’ তিনি আরও বলেন, সাবেক জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোর্শেদ জামান এই গণকবরে স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য ৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জন্য ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন প্রকল্পের জন্য ১৫ শতাংশ জায়গা দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জন্য বরাদ্দ পাওয়া গেলেও গণকবরের স্মৃতিফলক নির্মাণের বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন।
এদিকে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো মাধবদীর আলগীর তারিণী ভূঁইয়ার বাড়ি। বাড়িটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। পাশে একটি শহীদ স্মৃতিফলক থাকলেও ভবনটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেখানে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হক বলেন, এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাঁচদোনা, নরসিংদী, মাধবদী, জিনারদীসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করতেন। ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলা চালায়। তাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে সেদিন ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১০ জন শহীদ হন। তাঁদের মরদেহ এই আঙিনার কাঁঠালগাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই স্থানটি সংরক্ষণ করার কোনো উদ্যোগ নেই।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ বলেন, ‘আমাদের সহযোদ্ধারা অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। আবার অনেকেই বয়সের ভারে অসুস্থ। হয়তো ৫-১০ বছর পর আমরা কেউ থাকব না। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী এই গণকবরগুলো যদি যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যায়, তবে আমি বিশ্বাস করি, আগামী প্রজন্মের কেউ দেশদ্রোহী হতে পারবে না। তারা বুঝতে পারবে, কত ত্যাগের বিনিময়ে একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা কমান্ডার আবদুল মোতালিব পাঠান বলেন, ‘বিগত সময়ে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি ও স্বৈরাচার সরকার দেশ পরিচালনায় থাকায় সম্মুখ মুক্তিযুদ্ধের স্থান ও গণকবরগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই সরকারের সময়ে সেই অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত হবে বলে আমি আশাবাদী। এরই মধ্যে ছয়টি উপজেলায় ছয়টি গণকবর চিহ্নিত করে স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।’
জেলা প্রশাসক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, গণকবরগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য সরকারের প্রকল্পের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাঁচদোনায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৩০ শতাংশ জমি দেওয়া হয়েছে। সেখানে নরসিংদী সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও স্মৃতিস্তম্ভ হবে। এমন করে প্রতিটি উপজেলায় গণকবরগুলো সংরক্ষণ করে ভাস্কর্য আকারে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এগুলো সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান হবে।