রাজধানীর মিরপুর চিড়িয়াখানা সড়ক লাগোয়া ৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি সেন্টার। পাশ ঘেঁষে সরু গলিপথ। সেটামিশেছে ছোট একটি মাঠে। পুরোটা জুড়ে ময়লার স্তূপ। রিকশার অস্থায়ী গ্যারেজ ঢেকে রেখেছে একটি বিবর্ণ ত্রিভুজাকৃতি দেয়াল। এটিই রাইনখোলা বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয় তরুণেরা নিজ উদ্যোগে এটা তৈরি করেছেন।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, স্মৃতিস্তম্ভের দেয়াল ছুঁয়ে টিনের ছাপরাঘর তুলেছে একটি পরিবার। গৃহকর্ত্রী ছালমা বেগম জানান, পাশেই তাঁদের নিজেদের বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে বলে তাঁরা দুই মাসের জন্য অস্থায়ীভাবে এখানে বসবাস করছেন।
বধ্যভূমির একদিকে চৌকি পেতে শাকসবজি, জ্বালানি কাঠ, পিঠার দোকান খুলে বসেছেন কয়েকজন। নিম্ন আয়ের মানুষেরা মাঠজুড়ে শুকাতে দিয়েছে কাপড়।
মিরাজ মিজু রচিত মিরপুরের ১০ বধ্যভূমি শীর্ষক বই থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মাঠের কোনায় একটি পয়োনিষ্কাশনের রিজার্ভার ও পাম্পহাউস ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু মানুষকে হত্যা করে রিজার্ভারে ফেলে দেওয়া হয়। ২৫ ফুট গভীর রিজার্ভারটি ভরা ছিল লাশে। দুর্গন্ধের কারণে স্থানীয় লোকজন গর্তটি মাটি দিয়ে ঢেকে দেন।
সময়ের পরিক্রমায় বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকে রাইনখোলা বধ্যভূমি।
১৯৯৩ সালে পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ করার সময় আবার আলোচনায় আসে বধ্যভূমিটি। তখন গর্ত থেকে ৪০০-৫০০ মানুষের মাথার খুলি ও প্রচুর হাড়গোড় উদ্ধার হয়। পরবর্তী সময়ে এলাকার নকশা তৈরির সময় বধ্যভূমির জায়গাটুকু সরকারিভাবে বরাদ্দবহির্ভূত জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাকা শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (ডুইপ) প্লট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি নাসির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, সোসাইটি দীর্ঘদিন ধরে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছে। এ নিয়ে তাঁরা সদ্য প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি নিজে এসে দেখে গিয়েছিলেন। কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।
বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার কাজী টিপু সুলতান বলেন, মেয়র আনিসুল হকের অকাল প্রয়াণে বর্তমান প্যানেল মেয়রকেও এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
একাত্তরের বধ্যভূমিগুলোর বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত সংগঠন ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য অনুযায়ী মিরপুরে মোট বধ্যভূমির সংখ্যা ২৩। এর মধ্যে মিরপুর-১০ এলাকার জল্লাদখানা বধ্যভূমিটি ছাড়া আর কোনো বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০০০ সালে একটি চক্র রাইনখোলা বধ্যভূমির জায়গা দখলের চেষ্ট করেছিল। সে সময় এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন স্থানীয় তরুণেরা। তাঁদের দুজন শহীদ খান ও শেখ তোফাজ্জল হোসেন। তাঁরা বলেন, ‘সেই সময় আমরা এক রাতের মধ্যে নিজেদের বাড়ির ইট-সিমেন্ট দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটা নির্মাণ করি। তারপর অনেকেই এসে অনেক বড় বড় কথা বলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ওই সময় দেয়ালটুকু তুলতে না পারলে এটা এত দিনে ভূমিখেকোদের দখলে চলে যেত।’