১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন গাজীপুরে (জয়দেবপুর) পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর বড় ধরনের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে পাকবাহিনীর বিভিন্ন প্রকার ভারী অস্ত্র ও যানবাহন ধ্বংস এবং বহু পাকিস্তানী সেনা নিহত ও আহত হয়। আর জাতীয় পতাকা উড়ানো হয় গাজীপুরে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু পূর্বে ১৯ মার্চ গাজীপুরের মাটিতেই হয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সে সময় সারা দেশে শ্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। আবার বিজয় লাভের পূর্বক্ষণে ১৫ ডিসেম্বর এই গাজীপুরেই সংঘটিত হয়েছিল হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সর্বশেষ বড় ধরনের সম্মুখযুদ্ধ।
জানা গেছে, ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা করার পর গাজীপুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও বিভিন্ন পেশার স্বাধীনতাকামী মানুষ ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। পরে তারা ফিরে এসে জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে যুদ্ধে অংশ নেন। মূলত নভেম্বর মাস থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুরে সংঘবদ্ধ আক্রমণ শুরু করেন। জয়দেবপুর সেনানিবাস, সমরাস্ত্র কারখানা, রাজেন্দ্রপুর অর্ডিন্যান্স ডিপোসহ পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানে মুক্তিবাহিনী পরিকল্পিত আক্রমণ শুরু করে। ১৩-১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুরে সেনানিবাসে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করেন। আক্রমণে পর্যদস্ত পাকবাহিনী জয়দেবপুরে টিকতে না পেরে ঢাকা চলে যাবার মনস্থ করে।
এদিকে উত্তর রণাঙ্গন অর্থাৎ ময়মনসিংহ-জামালপুর-টাঙ্গাইল থেকেও পাকিস্তানী বাহিনী মিত্র ও মুক্তিবাহিনী এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর (কাদেরিয়া) বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পিছু হটে সড়কপথে ঢাকায় যাবার পথে জয়দেবপুরের চান্দনা-চেšরাস্তা জড়ো হয়। আসার পথে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কড্ডা ব্রিজটি ধ্বংস করে দিয়ে এলে ধাওয়া করা মিত্র ও মুক্তিবাহিনী গতিপথ পরিবর্তন করে কাশিমপুর গিয়ে অবস্থান নেয়। অপরদিকে জয়দেবপুর সেনানিবাস, সমরাস্ত্র কারখানা এবং অর্ডিন্যান্স ডিপো থেকেও পাকসেনারা ট্যাঙ্ক, অস্ত্রশস্ত্র সাজোয়া যানবাহনসহ জড়ো হয় চান্দনা চেšরাস্তায়।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা ও মিত্রবাহিনী ছয়দানা, মালেকের বাড়িসহ আশপাশ এলাকায় রাস্তার (ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের) দুপাশে বাঙ্কার খনন করে অবস্থান নেয়। ১৫ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ২৫-২৬টি গাড়িবহর নিয়ে একটি কনভয় চান্দনা-চেšরাস্তা থেকে ঢাকার পথে রওনা হয়। ছয়দানা এলাকা গাড়ি বহরটি ফাঁদ পাতা অ্যাম্বুসে ঢোকার পর কাশিমপুর থেকে মিত্র ও কাদেরিয়া বাহিনী তাদের ওপর কামান ও মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং মহাসড়কের দুপাশে অবস্থান নেওয়া মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর গুলিবর্ষণ করে। এতে ধ্বংস হয় পাকিস্তান বাহিনীর ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টার, যানবাহন ও গোলাবারুদ। হতাহত হয় অসংখ্য পাকিস্তানী সেনা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ঢাকার কাছে এটাই ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। পাকবাহিনীর ওপর গোলাবর্ষণ ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
গাজীপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ও সাবেক সংসদ সদস্য কাজী মোজাম্মেল হক জানান, ১৫ ডিসেম্বর জানতে পারি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একটা কনভয় ঢাকা যাবে। ছয়দানা, মালেকের বাড়ি এলাকায় মিত্রবাহিনী অবস্থান করছিল। খবর পেয়ে আমরাও তাদের সঙ্গে অবস্থান করি। মিত্রবাহিনী এবং আমরা এ সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এতে পাকিস্তান বাহিনীর সম্পূর্ণ কনভয় ধ্বংসসহ তাদের সৈন্যরা হতাহত হয় এবং আমাদের কাছে আটক হয়। এভাবেই তাদের বাহিনীকে ঢাকা যাওয়া প্রতিহত করে পরাজিত করতে পারি। এ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে গাজীপুর হানাদার মুক্ত হয়।
ড. এ কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামাবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম