দৈর্ঘ্যে সাত আর প্রস্থে তিন ফুটের ছোট্ট একটি কক্ষ। সেখানে গোল হয়ে বসেছেন জনা দশেক যুবক ও মধ্যবয়সী পুরুষ। তাঁদের কারও হাতে কৃত্রিম চামড়া, কারও হাতে আঠা, কেউবা কাঁচি দিয়ে নকশা কাটছেন। এরা সবাই হাতে তৈরি জুতার কারিগর। তবে আর আট-দশজন কারিগরের চেয়ে এদের পরিচয়টা একটু ভিন্ন। এই কারিগরেরা সবাই বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। কারাগারে জুতা তৈরির কারখানায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্ত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সম্প্রতি দুপুরে সেখানে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়। কারাগারের বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেন ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে জুতা তৈরির কারখানাটি রয়েছে। সেখানে কাজ করা কয়েদি হাফেজ, মিজান, রমজান, শিমুলরা জানান, সাজা শেষ হওয়ার পথে। মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা নিজেরাই জুতা তৈরি করে বিক্রি করবেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে জুতা তৈরির কারখানা চালু করা হয়। কারাগারে আটক সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা এসব জুতা তৈরি করে থাকেন। জুতার নাম দেওয়া হয়েছে ‘জে এম সু’ (জেল মেইড সু)। এখন তৈরি হচ্ছে শুধু নারীদের জুতা। জুতা তৈরির উপকরণ বাবদ দৈনিক ব্যয় হচ্ছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। তা বাজারজাত করা হচ্ছে দুই হাজার টাকায়। দৈনিক দুই ডজন জুতা তৈরি হচ্ছে। এতে দৈনিক লাভ হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক ইকবাল কবির চৌধুরী বলেন, জুতা বাজারজাত করে যে লাভ হচ্ছে তার ৩ ভাগের ১ ভাগ পাচ্ছেন কয়েদি কারিগরেরা। বাকি ২ ভাগের ১ ভাগ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে, আরেক ভাগ বন্দী উন্নয়ন ফান্ডে যাচ্ছে।
কারাগারে কয়েদিদের কাজ শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখানোর নেপথ্যে রয়েছেন মনির উদ্দিন নামের এক জুতার কারিগর। চট্টগ্রাম নগরের নূপুর মার্কেটে ছিল তাঁর জুতার দোকান ও কারখানা। চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় তিনি ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সাজা শেষে মুক্তি পান। মূলত তাঁর আগ্রহে কারাগারে জুতা তৈরির কারখানা চালু হয়। তাঁকে সহযোগিতা করেন তৎকালীন কারাধ্যক্ষ (বর্তমানে ঢাকা কারাগার) মাহবুবুল ইসলাম। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক ইকবাল কবীর চৌধুরী বলেন, কারখানা দেখভালের জন্য মনির নিয়মিত আসেন। আগামী এক বছরের মধ্যে কারাগারে দুই থেকে আড়াই শ কয়েদি কারিগরের সমন্বয়ে জুতা তৈরির বড় একটি কারখানা চালুর ইচ্ছে রয়েছে তাঁদের।
কারাগারে বর্তমানে এই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ২০ জন বন্দী। এদের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়ে বের হতে পেরেছেন নেজাম উদ্দিন নামের একজন। মাদক মামলায় সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া নেজাম উদ্দিন গত জুলাইয়ে ছাড়া পান। এর পরের মাসেই নগরের জলসা মার্কেটের ছয়তলায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে জুতার কারখানা চালু করেন তিনি।
৪ ডিসেম্বর দুপুরে নেজামের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, সাতজন শ্রমিক নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
নেজাম বলেন, জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঋণ ও নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে জুতা তৈরি শুরু করেন। এখন প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে তাঁর।
কারা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬ হাজার ৩৭৩ জন বন্দী রয়েছেন। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬২৩ জন হাজতি। সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী রয়েছেন ৫৪৯ জন। তাঁরাই কারাগারে কাজ করে থাকেন। জুতা তৈরি ছাড়াও বন্দীরা কাপড় সেলাই, টেলিভিশন মেরামত, তাঁতে কাপড় বোনা, কাঠের আসবাব এবং মোড়া তৈরিসহ নানা কাজ করে থাকেন। তবে দেশের কারাগারগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে জুতা তৈরির কারখানা প্রথম চালু হয়েছে।
এ উদ্যোগের প্রশংসা করে কারা প্রশাসনের সাবেক উপমহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, কারাগার থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া বন্দীরা মুক্তির পর স্বাবলম্বী হবেন। এতে তাঁরা ফের অপরাধে জড়াবেন না। এতে দেশ ও সমাজের সবাই উপকৃত হবেন।