লাল ইটে ঠিকরে পড়ছে দুপুরের রোদ। ছড়াচ্ছে বর্ণিল আলো। কৃষ্ণচূড়া, শিমুলের পাতায় মৃদু দুলুনি। এর মধ্যেই ঝাড়-পোঁছের কাজ করছেন একদল নারী-পুরুষ। দম ফেলার ফুরসত নেই। স্মৃতিসৌধটি ঝকঝকে করার কঠিন দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে।
বরাবরের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে ঘিরে বছরে একবারই ধোয়ামোছার কাজ চলে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। বাকি সময় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। হকার আর ছিন্নমূলদের রাজত্ব। মাদকসেবীদের আড্ডাও বসে।
রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রোকাইয়া হাসিনা মিলি শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের মেয়ে। তিনি বলেন, ‘সারা বছর স্মৃতিসৌধের যে অবস্থা থাকে, তাতে উপেক্ষা এবং অবহেলা স্পষ্ট। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের জন্য এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও কষ্টকর।’
গতবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাজনৈতিক পোস্টারে স্মৃতিসৌধ সয়লাব ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শহীদদের পরিচয় তুলে ধরার তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। মনে হয় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা মানুষের জন্যই এ আয়োজন।’
১৯৭১ সালে বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। হত্যার জন্য বেছে নেওয়া হয় রায়েরবাজারের ইটখোলা। এই শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯৯ সালে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ১১ থেকে ১৩ ডিসেম্বর স্মৃতিসৌধে সর্বসাধারণের প্রবেশ বন্ধ। গতকাল দুপুরে দেখা যায়, ধোয়ামোছা কাজের ঠিকাদার মো. সেকান্দার পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছেন। একসঙ্গে ঝাড়ু দিচ্ছেন ১৫ জন নারী। তাঁদের একজন ৪৫ বছর বয়সী মিনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘চাইর দিন ধইরা সব ওয়ালে ব্রাশ মাইরা পরিষ্কার করছি। হাউসের মধ্যে নাইম্যা শেওলা ডলছি। আইজ খালি ঝাড়ু মারতেছি।’
একই কথা জানালেন মো. সেকান্দার। তিনি বলেন, ‘বছরে কয়েকবার পরিষ্কার করলে জায়গাটা পবিত্র থাকত। খরচও কম পড়ত।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষাকালজুড়ে স্মৃতিসৌধের সামনের রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কাদামাটি ভেঙে দর্শনার্থীদের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়েছে। এতে সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়ত নারী-শিশুরা।
দেখা গেছে, স্মৃতিসৌধের সামনের রাস্তায় এবং ভেতরে বালু ফেলে ঠিক করা হচ্ছে। লাগানো হয়েছে নতুন ঘাস। ইটগুলো ধোয়া হচ্ছে।
পরিচ্ছন্নতার কাজটি কেবল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেই কেন, জানতে চাইলে স্মৃতিসৌধের ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. মোহসিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। এ ক্ষেত্রে লোকবল কম উল্লেখ করে মো. মোহসিন বলেন, ‘জনগণেরও সচেতনতার অভাব আছে। এ জায়গার পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব সবার।’
স্মৃতিসৌধটি বিনোদন পার্কের মতো ব্যবহৃত হয় বলে উল্লেখ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর। তিনি বলেন, ‘স্মৃতিসৌধ নির্মাণকালে এর ভাবগাম্ভীর্য রক্ষায় শহীদ পরিবার থেকে কিছু প্রস্তাব ছিল, যার সঙ্গে কর্তৃপক্ষ একমত পোষণ করেছিল। তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি।’
স্মৃতিসৌধে স্থায়ীভাবে চারজন নিরাপত্তাকর্মী কাজ করেন। তাঁদের একজন মো. মতিন বলেন, ‘সন্ধ্যার পরে এখানে বখাটেরা আসে। তারা আমাদের মারধরের হুমকি দেয়। অনেকের সঙ্গে চাকুও থাকে।’ ২০০৬ সালে নিরাপত্তা রক্ষাকে কেন্দ্র করে মারধরের শিকার একজন নিরাপত্তাকর্মী মারা গেছেন বলে জানা যায়।
স্থানীয় লোকজনের বেশির ভাগই জানেন না কেন এ সৌধ। পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত ১৫ নারীর মধ্যে মাত্র একজন বলেছেন ‘এইটা বুদ্ধিজীবী। যুদ্ধের সময় এইহানে মানুষ মারছে।’ এ কথা শেষ না হতেই বাকি ১৪ জন ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেন, ‘না, এইটা শহীদ মিনার।’ তবে নিরাপত্তাকর্মীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়া ১০ বছরের শিশু রিয়াদ হোসেন বলে, ‘যুদ্ধের সময় এখানে বুদ্ধিজীবীদের মারা হয়েছে।’
পরের প্রজন্মের কাছে এই আত্মত্যাগের বিবরণ তুলে ধরার কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। এমনকি বুদ্ধিজীবী শহীদদের নিয়ে নেই কোনো স্মরণিকাও।
স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদপ্তরের। অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আগের তুলনায় গত এক বছরে নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক জোরদার করা হয়েছে। তবে স্থায়ী লোকবলের অভাবে কিছু সমস্যা হয়।’ স্মরণিকা বা শহীদদের পরিচিতি তুলে ধরার বিষয়ে তিনি বলেন, এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কেবল লজিস্টিক (উপকরণগত) সহযোগিতা দেওয়া।