মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার ‘মৃত্যু’

Slider সারাবিশ্ব

0808bbc437fb0325ecb2301d61bf4f3d-5a29c1c284a69

 

 

 

 

জেরুজালেম প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন যৌথভাবে—মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়ার চূড়ান্ত সমাধানের অংশ হিসেবে ৭০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি অনুসরণ করে এসেছে। বুধবার সেই নিয়ম ভেঙে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই শহরকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি এবং এখানে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেন।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভেঙে একদিকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল, অন্যদিকে আরব ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, তাতে জেরুজালেমের জন্য স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েল পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং এককভাবে তা নিজ দেশের অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেয়। সেই অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো মেনে নেয়নি। ১৯৯৫ সালে ইসরায়েল ও পিএলও স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তিতে উভয় পক্ষ মেনে নেয় যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জেরুজালেমের প্রশ্নটি নির্ধারিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ২০০০ সালে হোয়াইট হাউসের লনে ইসরায়েলি নেতা র‍্যাবিন ও ফিলিস্তিন নেতা আরাফাত যে শান্তি কাঠামো স্বাক্ষর করেন, তাতেও এই প্রশ্নে উভয় পক্ষের সম্মতি ছিল।

কলমের এক খোঁচায় সব বদলে দিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর দক্ষিণপন্থী ইহুদি নেতারা দীর্ঘদিন ধরে জেরুজালেমকে নিজেদের একচ্ছত্র রাজধানীর স্বীকৃতির দাবি করে আসছেন। ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচিত হলে এই দাবি তিনি মেনে নেবেন। আপাতভাবে ট্রাম্প নিজের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন, কিন্তু এই এক ঘটনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রশ্নে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজের ভূমিকা তিনি নিজেই বাতিল করে দিলেন।

ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, এর ফলে শান্তিপ্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকাপাকি হলো। এরপর যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপ্রক্রিয়ার নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে আর দাবি করতে পারে না। ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎস এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করেছে, এই সিদ্ধান্তে শুধু লাভ হলো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তাঁর অতি কট্টরপন্থী সমর্থকদের।

আরও স্পষ্ট করে বলেছেন ফিলিস্তিনি নেতা হানান আশরাভি। তাঁর কথায়, এর ফলে কেবল শান্তিপ্রক্রিয়ার মৃত্যু হলো তা–ই নয়, এই অঞ্চলে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া ত্বরান্বিত হলো।

জেরুজালেম আরব ও ইহুদি উভয়ের কাছে পবিত্র নগর। কয়েক বছর আগে কাজের সূত্রে আমি এই শহরে গিয়েছিলাম। তখন পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেমের ফারাক দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। পশ্চিম জেরুজালেম সব সুযোগসংবলিত অতি আধুনিক একটি শহর, পূর্ব জেরুজালেম ভগ্নপ্রায়। এই শহরের প্রায় সাড়ে তিন লাখ ফিলিস্তিনি অধিবাসীর জন্য নির্ধারিত এলাকায় ইসরায়েল ক্রমশই নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ করে চলেছে, এর ফলে পূর্ব জেরুজালেম দ্রুত তার আরব চরিত্র হারাচ্ছে। পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসন বসতি সম্প্রসারণে আপত্তি জানালেও ট্রাম্প তাতে নীরব সম্মতি জানিয়েছেন। ইসরায়েলে ট্রাম্পের নতুন রাষ্ট্রদূত এই সম্প্রসারণের পক্ষে। এ ব্যাপারে তিনি কোনো রাখঢাক করেননি।

ঠিক এ সময়েই কেন ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই রহস্য এখনো উদ্‌ঘাটিত হয়নি। তিনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই কাজে নেতৃত্ব দিতে তিনি নিজ জামাতা জ্যারেড কুশনারকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ঠিক কীভাবে শান্তি আসবে, তাঁদের কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা আছে কি না, ট্রাম্প বা কুশনার কেউই তা খোলাসা করে বলেননি। বুধবার তাঁর ঘোষণায় ট্রাম্প দাবি করেন, শান্তিপ্রক্রিয়ায় নতুন পথ অনুসরণের জন্যই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। ‘আমি ঠিক কাজটিই করেছি।’ বলেন তিনি।

কোনো কোনো ভাষ্যকার অবশ্য অন্ধকারেও আলোর সম্ভাবনা দেখেছেন। লক্ষণীয়, বুধবারের ঘোষণায় ট্রাম্প এই এলাকায় আরব ও ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র দুটি রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন জানান। যদি দুই পক্ষ তা–ই চায়, তাহলে তিনি তাতে সমর্থন জানাবেন। আরও লক্ষণীয়, একই ঘোষণায় ট্রাম্প ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের চূড়ান্ত সীমান্ত কী হবে, সে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। তা থেকে কেউ কেউ ধরে নিয়েছেন, দুই পক্ষ চাইলে পূর্ব জেরুজালেমে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানীও হতে পারে। সে সিদ্ধান্ত নেবে বিবাদের দুই পক্ষ। ট্রাম্প আরও জানিয়েছেন, শান্তিপ্রক্রিয়া প্রশ্নে আলোচনা চলবে, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সেই উদ্দেশ্যে খুব শিগগির এই অঞ্চল সফরে আসবেন।

ঘোষিত হলেও এ মুহূর্তেই জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরিত হচ্ছে না। এ জন্য জায়গা নির্বাচন থেকে ভবন নির্মাণের জন্য তিন-চার বছর লেগে যাবে। ট্রাম্পের সময়কালে এই সিদ্ধান্ত আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

শান্তিপ্রক্রিয়ার সমর্থনে ট্রাম্প এ সিদ্ধান্ত নেননি। কোনো কোনো ভাষ্যকার বলেছেন, তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল নিজের রক্ষণশীল সমর্থকদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা পোক্ত করা। শুধু মার্কিন ইহুদি লবি নয়, রিপাবলিকান দলের ইভানজেলিক্যাল অংশ এই সিদ্ধান্তে তাদের সন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছে। কংগ্রেসে দুই দলের অধিকাংশ সদস্যই এই সিদ্ধান্তে নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।

মনে রাখা দরকার, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময় নেওয়া হলো, যখন ফিলিস্তিনি ও আরব বিশ্ব প্রবলভাবে বিভক্ত। ট্রাম্প তাঁদের দুর্বলতার এই সুযোগ গ্রহণ করলেন। কোনো কোনো আরব দেশ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানালেও এই প্রশ্নে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ তারা নেবে—একথা ভাবার কোনো কারণ নেই। সৌদি আরব ইরানকে একঘরে করার লক্ষ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, মিসর ও আমিরাতের রাজ্যগুলোও এই আঁতাতের অংশ। মিসরের ধর্মীয় নেতারা ইসরায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাসকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

ইউরোপীয়রা নীতিগতভাবে ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে কথা বললেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাহসী কোনো পদক্ষেপ তারা নেবে না, এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই। জাতিসংঘ আরও একটি অর্থহীন প্রস্তাব গ্রহণের চেষ্টা নেবে, যা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিতে ভেস্তে যাবে।

এই অবস্থায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সব ভার বহন ফিলিস্তিনিদের একাই বহন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষাকর্তা হবে—এত দিন এই ভ্রম তাঁরা জাগিয়ে রেখেছে। মাহমুদ আব্বাসের বিভক্ত ও দুর্বল নেতৃত্ব সেই ভ্রম কাটিয়ে উঠলেও আরেক দফা বিক্ষোভ ও সহিংসতার বাইরে তাঁরা আর কী করতে পারেন, তা পরিষ্কার নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *