১৯৪২ সাল। চীনের চংকিংয়ের ছোট্ট গ্রাম গাওতান। গ্রামবাসীর প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, দুধদাঁত পড়ে যাওয়া শিশুদের মুখের ভেতরে নতুন বউ হাত দিলে ওই শিশু সৌভাগ্যবান হয়।
বছর ছয়েকের লিউ গুয়োজিয়াংয়ের ক্ষেত্রেও সেদিন একই ঘটনা ঘটে। দুধদাঁতের সুবাদেই ১৬ বছরের কিশোরী নববধূ জু চাওকিংয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার। স্থানীয় লোকজন নির্দেশে লিউ মুখ হাঁ করেছিল; আর বউ জু তার মুখের ভেতর হাত দিতেই দুষ্টু লিউ বসিয়ে দিয়েছিল কামড়। এ সময় পালকির পর্দা সরিয়ে জু এক পলক দেখেছিল লিউকে। লিউও দেখেছিল তাকে।
এমন সময় পাশ থেকে এক নারী লিউকে হেসে বলেছিলেন, ‘এই পুঁচকে শয়তান। বড় হলে এমনই এক সুন্দর বউ খুঁজে নিয়ো।’ ব্যস, সেই থেকে শুরু। লিউয়ের শিশুমনে বউ বলতে তখন কেবল জু। কেউ তাকে দুষ্টুমি করে কেমন বউ চাই বলতেই অকপটে লিউ বলত, ‘আমার ওই জুয়ের মতো বউ চাই।’
ক্লাউড মাইন্ড ডট ইনফোর প্রতিবেদনে বলা হয়, গাওতান গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল জুয়ের। তাঁদের ঘরে আসে চার সন্তান। বিয়ের ১০ বছর পর ১৯৫২ সালে মেনিনজাইটিস রোগে ভুগে মারা যান তাঁর স্বামী। চার সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন জু। ঝোপঝাড়ের মাশরুম খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। এক সন্ধ্যাবেলায় জু তাঁর ছোট সন্তানকে পিঠে নিয়ে বাড়ির পাশের নদীতে পানি আনতে গিয়েছিলেন। পানি নিয়ে ওঠার সময় পা পিছলে সন্তানসহ নদীতে পড়ে ডুবে যেতে থাকেন তিনি। পাশেই ছিলেন লিউ। সঙ্গে সঙ্গে নদীতে লাফ দিয়ে জু ও তাঁর সন্তানকে উদ্ধার করেন লিউ। এবার মুখোমুখি কথা হয় তাঁদের।
লিউয়ের তখন ১৬, আর জু ২৬ বছরের তরুণী। সব শুনে জুয়ের পাশে দাঁড়ান লিউ। সহযোগিতা করতে নিয়মিত জুয়ের বাড়িতে যাতায়াত বেড়ে যায় লিউয়ের। বন্ধু হিসেবে লিউকে পেয়ে জু খুব খুশি। আর লিউয়ের মনে উঁকি দেয় সেই শৈশব থেকে লালন করা প্রেম। এভাবে কেটে যায় আরও তিন বছর। আশপাশের মানুষ ও দুই পরিবার কেউই জু ও লিউয়ের এই অসম সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। চারদিকে কানাঘুষো চলে। চাপ বেড়ে যায় জুয়ের ওপর। বুকে পাথর চেপে ১৯৫৬ সালের একদিন লিউকে বাড়িতে আসতে ও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বারণ করেন জু। সেদিন রাতেই বুকে সাহস নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন লিউ। রাজি হয়ে যান জু। পরদিন ভোরে সবাই জেগে ওঠার আগেই চার সন্তান নিয়ে জু আর লিউ গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকে গ্রামবাসী তাঁদের আর কোনো খোঁজ পায়নি।
উইমেন অব চায়নার প্রতিবেদনে বলা হয়, চার সন্তান নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরের এক উঁচু পাহাড়ে গিয়ে ওঠেন তাঁরা। গহিন বন পেরিয়ে নির্জন এই পাহাড়ে কেউ কোনো দিন আসবে না ভেবে সেখানেই বাস করার সিদ্ধান্ত নেন। যেন তাঁদের ভালোবাসার মাঝে আর কেউ কোনো দিন বাধা দিতে না পারে। দুজনে মিলে একটি কুঁড়েঘর তৈরি করে সেখানে থাকতে শুরু করেন। মাছ শিকার, গাছের ফল, খেজুর ও বনের সবজি খেয়েই দিন কাটাচ্ছিলেন লিউ আর জু। জুয়ের প্রথম স্বামীর চার সন্তানের মধ্যে ছোট সন্তানের মৃত্যু হয়। ভালোবাসার ফসল হিসেবে তাঁদের কুঁড়েঘরে জন্ম নেয় আরও চার সন্তান। সন্তানেরা বড় হয়ে গেলে তাঁরা মা-বাবাকে নিয়ে সমতলে ফিরে যেতে চান। কিন্তু তাঁরা নাছোড়। যে জায়গায় তাঁদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে, সেই পাহাড় ছেড়ে তাঁরা কিছুতেই সমতলে ফেরত যাবেন না। বাধ্য হয়ে সন্তানেরা মা-বাবাকে ছেড়ে সমতলে চলে যান। তত দিনে কিছুটা বৃদ্ধ হয়ে পড়েন লিউ ও জু। এর মধ্যে একটা দিনও তাঁরা একে অপরকে ছেড়ে কাটাননি।
পাহাড়ি পিচ্ছিল পথে চলাফেরায় যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, এ কারণে ৫৭ বছর ধরে সমতল থেকে পাহাড়চূড়া পর্যন্ত মাটি ও পাথর খুঁড়ে ছয় হাজার সিঁড়ি তৈরি করেছিলেন লিউ। বাটালির সাহায্যে তিনি এই সিঁড়ি তৈরি করেন। পুরো ছয় হাজার সিঁড়ি তৈরি করতে ৩৬টি বাটালি ভেঙেছিলেন তিনি।
প্রেসরিডারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৫৬ সাল থেকে লিউ আর জুয়ের খোঁজ পায়নি কেউ। কিন্তু ২০০১ সালে একটি অভিযাত্রী দল ঘুরতে ঘুরতে ওই পাহাড়ের কাছে চলে যান। এমন দুর্গম পাহাড়ে এত লম্বা সিঁড়ি দেখে তাঁদের সন্দেহ হয়। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকেন ওপরে। একদম ওপরে গিয়ে কুঁড়েঘরে দেখা মেলে বৃদ্ধ লিউ আর জুয়ের। এত দিন পর বাইরের মানুষ পেয়ে মনের আগল ভেঙে ফেলেন তাঁরা। অকপটে বলে ফেলেন নিজের প্রেমের গল্প। অভিযাত্রী দল ফিরে গেলে গণমাধ্যমে ছাপা হয় অসাধারণ সেই প্রেমের কাহিনি। বিশ্বের বিস্ময়কর কয়েকটি প্রেমকাহিনির মধ্যে স্থান করে নেয় লিউ আর জুয়ের গল্প। তাঁদের সেই প্রেমের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ল্যাডার অব লাভ’। ২০০৬ সালে চীনের সেরা ১০টি প্রেমের গল্পের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে চলে যায় লিউ ও জুয়ের জীবনকাহিনি। চীনের সার্চ ইঞ্জিন বাইদুতে খোঁজার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ‘ল্যাডার অব লাভ’।
চায়না ডেইলির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৭ সালে ৭২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় লিউয়ের। মৃত্যুর সময়ও জুয়ের হাত শক্ত করে ধরে ছিলেন লিউ। তাঁদের এক সন্তান লিউ মিংশেং বলেন, ‘বাবা-মা একে অপরকে অসম্ভব রকম ভালোবাসতেন। তাঁদের ভালোবাসা এমনই ছিল যে বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের হাত ছাড়াতে বেগ পেতে হয়েছিল।’
২০০৬ সালে জুয়ের একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানে লিউয়ের মাটি কেটে সিঁড়ি তৈরি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর জন্য আমার খুব চিন্তা হতো। কিন্তু তিনি বলতেন, সিঁড়ি তৈরি হয়ে গেলে দেখবে এই পাহাড় থেকে তোমার ওঠানামায় কোনো কষ্ট হবে না।’
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বামী লিউয়ের স্মৃতি আগলে একলা প্রহর গুনতে গুনতে ২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর মৃত্যু হয় জুয়ের। প্রায় ৮৮ বছর বয়সী জু লিউকে ছেড়ে যে কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন, তিনি সব সময় শুধু একটি কথাই বলেছিলেন, ‘তুমি কথা দিয়েছিলে, আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি ভালোবাসবে। কিন্তু তুমি যে আমাকে রেখে আগেই চলে গেলে! এখন তোমাকে ছেড়ে আমি বাঁচব কী করে?’
এই পৃথিবী ছেড়ে লিউ ও জু চলে গেছেন। কিন্তু থেকে গেছে তাঁদের অমর প্রেমের গল্প। সেই গল্পের সাক্ষী হয়ে আছে লিউয়ের হাতে তৈরি ছয় হাজার ধাপের ভালোবাসার সিঁড়ি। তাঁদের জীবনকাহিনি নিয়ে চীনে নির্মাণ করা হয়েছে তথ্যচিত্র ও সিনেমা। স্থানীয় সরকারও তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে ওই পাহাড় ও এলাকা সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা এখন ওই এলাকায় ঘুরতে গিয়ে ভালোবাসার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যান।