রিদা অর্থ চাদরজাতীয় কাপড়, যা শরীরের ঊর্ধ্বাংশে জড়ানো হয়। সাধারণভাবে লুঙ্গির সঙ্গে রিদা বা চাদর পরিধান করাই ছিল আরব দেশের সর্বাধিক প্রচলিত পোশাক।
এটি একই ধরনের দুটি ‘থান’ কাপড়। যাকে নিম্নাঙ্গে পরিধান করা হয়, তাকে ‘ইযার’ বলা হয়। আর ঊর্ধ্বাঙ্গে পরিধান করা হলে তাকে রিদা বা চাদর বলা হয়। এ অর্থে আরো অনেক শব্দ হাদিস শরিফে ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত এসব চাদর দিয়ে সরাসরি শরীর আবৃত করা হতো। কখনো এগুলো অন্য কোনো পোশাকের ওপরও পরিধান করা হতো। এসব চাদরের আকৃতি, রং, তৈরির উপাদান ইত্যাদির কারণে এর আরবি নামেরও পার্থক্য আছে।
আগের দিনে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা বড় কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকার রুসুম মেনে চলত। পারস্যের শাহ্ পরিবারের ছেলেরাই এ ব্যাপারে অগ্রবর্তী।
চাদর শব্দটি পারস্যের হলেও চাদরের চল ছিল অনেক দেশেই। এমনকি পারস্যের আগেও চাদর ছিল দেশে দেশে। যেমন গ্রিক আর বাইজানটাইন মেয়েরা নিজেদের চাদরে ঢেকেই জনসম্মুখে যেতেন। সাধারণত তাঁরা বড় সাদা কাপড় ব্যবহার করতেন। তবে ওই সব কাপড়ে হাতের কারুকাজ থাকত। সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের জন্য বাহারি আব্রু তৈরি করতেন তখনকার পোশাকশিল্পীরা। তাঁরা সুন্দর করার প্রতিযোগিতায়ও নামতেন।
পারস্যের শাসকরা মেয়েদের আব্রুর ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। গ্রিসের তুলনায় পারস্যের চাদর একটু ছোট হয়। পারস্যের চাদরে শরীর ঢাকা পড়ত আর গ্রিসের চাদর মাটিতেও লুটাত। সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তেই চাদরের দৈর্ঘ্য ছোট হতে থাকে।
মহানবী (সা.)-এর চাদরের আয়তন ইমাম ওয়াকিদি (রহ.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রিদা বা চাদরের দৈর্ঘ্য ছিল ছয় হাত এবং প্রস্থ ছিল তিন হাত।
অন্য বর্ণনায় উরওয়া বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যে চাদর পরিধান করে বিশেষ মেহমান ও আগন্তুকদের সামনে আসতেন, তার দৈর্ঘ্য ছিল চার হাত এবং প্রস্থ ছিল দুই হাত ও এক বিঘত। এ চাদর এখনো (উমাইয়া যুগে, হিজরি প্রথম শতকের শেষ দিকে) খলিফাদের কাছে রয়েছে। তা পুরনো হয়ে গেছে। এ জন্য তাঁরা অন্য কাপড় দিয়ে তা জড়িয়ে নিয়েছেন। তাঁরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় তা পরিধান করতেন। হজরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাপড়ের দৈর্ঘ্য ছিল চার হাত ও এক বিঘত এবং প্রস্থ ছিল এক হাত।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) চতুর্ভুজ সমান দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের চাদর পরিধান করতেন। মোট কথা হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) চার থেকে ছয় হাত দৈর্ঘ্য ও দেড় থেকে তিন হাত প্রস্থ চাদর পরিধান করতেন।
রিদা বা চাদর পরিধান করার পদ্ধতি
চাদর পরিধানের বিষয়ে আমরা স্বভাবতই বুঝতে পারি যে কাঁধের ওপর রেখে দুই প্রান্ত দুই দিকে বা এক দিকে রেখে চাদর পরা হয়। এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময় শরীরে পেঁচিয়ে চাদর পরিধান করতেন। কখনো বা বাঁ কাঁধের ওপর চাদর রেখে ডান কাঁধ খোলা রেখে বগলের নিচে দিয়ে পেঁচিয়ে চাদর পরিধান করতেন। সাধারণভাবে চাদর মাথা আবৃত করার জন্য ব্যবহার করা হয় না। তবে কখনো কখনো তিনি চাদর বা চাদরের প্রান্ত দিয়ে মাথা আবৃত করতেন বা চাদরকে মাথার ওপর রুমাল হিসেবে ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।
আল্লামা ইবনে ইউসুফ শামি (রহ.) উল্লেখ করেছেন, হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসতিসকা বা বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজে নিজের শরীরের চাদর ঘুরিয়ে নেন। এতে প্রমাণিত হয়, তিনি চাদর পরতেন মাথার ওপর দিয়ে। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি মাথা ও দুই কাঁধের ওপর চাদর ফেলে রাখতেন, তা জড়িয়ে নিতেন না।
লুঙ্গি ও চাদরবিষয়ক হাদিসগুলো থেকে জানা যায়—ক. সেলাইবিহীন লুঙ্গি ও চাদর আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পোশাক ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এটি ব্যবহার করতেন।
খ. এ পোশাকই ছিল সবচেয়ে সাধারণ ও স্বাভাবিক পোশাক। এ জন্য হজের সময় স্বাভাবিকতা ও সাজগোজহীনতা প্রকাশের জন্য এ পোশাক পরিধান করা হতো।
গ. রাসুলুল্লাহ (সা.) তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন রঙের লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করেছেন। কালো, সবুজ, সাদা, লাল, হলুদ ও মিশ্রিত ডোরাকাটা রঙের চাদর ও লুঙ্গি তিনি পরিধান করেছেন বলে বিভিন্ন হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি। এগুলোর মধ্যে সবুজ বা মিশ্র রং তিনি বিশেষভাবে পছন্দ করতেন এবং সাদা রঙের পোশাক পরতে উৎসাহ দিয়েছেন বলে বর্ণিত হয়েছে। ডোরাকাটা রঙের পোশাক তিনি পছন্দ করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে।
ঘ. রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত কম দামের পাঁচ থেকে সাত দিরহামের লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করেছেন। আবার অত্যন্ত দামি তিন হাজার দিরহামের লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর সাধারণ রীতি ছিল, সাধারণভাবে সহজলভ্য ও বিলাসিতামুক্ত পোশাক পরিধান করা। কেউ দামি পোশাক হাদিয়া দিলে তা ফিরিয়ে না দিয়ে প্রয়োজনমতো তিনি ব্যবহার করতেন।
ঙ. রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বাভাবিকভাবেই সেলাইবিহীন লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করতেন। চাদর স্বাভাবিকভাবে কাঁধের ওপর দিয়ে গায়ে জড়াতেন। মাথার ওপর দিয়েও পরিধান করতেন বলে কেউ কেউ দাবি করেছেন। তাই এ ক্ষেত্রে মানুষের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা রয়েছে।
আবদুল কাইয়ুম আল আমিন
লেখক : ইতিহাস গবেষক