ফুটপাত হোক পথচারীর

বাধ ভাঙ্গা মত

Probhash-Amin1-311x186একটি ভালো উদ্যোগ কীভাবে মাঠে মারা যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে পথচারীদের হাঁটা শেখাতে পুলিশের চলমান অভিযান। চরম বাড়াবাড়ির কারণে ধন্যবাদের বদলে তাদের প্রাপ্য তিরস্কার। পথচারীদের ফুটওভারব্রিজ আর আন্ডারপাস ব্যবহারে আপনি উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, বাধ্য করতে পারেন না। পুলিশ যেভাবে অফিসগামী ব্যস্ত মানুষদের ছিনতাইকারীর মতো দৌড়ে বেল্টে ধরে, কলারে ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে আনছে তা অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন। এটা অবশ্যই অপরাধ। পথচারীরা কেউ চোর, ডাকাত নয়। তাদের যেভাবে রাজপথে, প্রকাশ্যে, টিভি ক্যামেরার সামনে হেনস্থা করা হচ্ছে আইনের শাসন থাকলে ডিএমপি কমিশনারকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো।

পুলিশ চাইলে শুরুতে বাধা দিলেই কেউ আর রাস্তা পার হতো না। কিন্তু পুলিশ অপেক্ষা করে, কখন কেউ রাস্তা পার হবে। তারপর ধরবে। এটা খুবই আপত্তিকর। আইনের শাসন নেই বলে এক ভদ্রমহিলা আইন দাঁতে তুলে নিয়েছেন। নারী পুলিশকে কামড়ে দিয়েছেন। মানুষের আত্মসম্মানবোধ অনেক প্রবল। আপনি যথন তাতে আঘাত করবেন, সে তার ক্ষুদ্র সামর্থে যে পাল্টা আঘাত করবেই। পুলিশকে কামড় দেয়ার অপরাধে এই নারীর এক মাসের কারাদণ্ড হয়েছে। আমি নিশ্চিত এই নারী আত্মতৃপ্তির সাথে কারাভোগ করছেন। কারণ তিনি তাকে অপমানের প্রতিবাদ করতে পেরেছিলেন। আমি সসম্মানে প্রবল আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এই ভদ্রমহিলার মুক্তি দাবি করছি। পুলিশ ভাইয়েরা অনেক কষ্ট করেন। কিন্তু সবকিছুর আগে মানুষকে সম্মান দিতে জানতে হবে। অথচ শুরুতেই বলেছি, পুলিশের এই উদ্যোগটি ভালো এবং দরকারী। গত ১০ বছর ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ঢাকায় অনেক দুর্ঘটনার জন্য, যানজটের জন্য পথচারীরা দায়ী। দ্রুতগতির গাড়ির সামনে দিয়ে যখন অসচেতন পথচারী হুট করে দৌঁড় দেন, চালকের পক্ষে গাড়ি সামলানো কঠিন হয়ে যায়। আমরা প্রায়ই দেখি ফুটওভার ব্রিজ ফাঁকা আর নিচ দিয়ে কাটাতার ঠেলে রাস্তা পেরুচ্ছে মানুষ।
গত ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে ইতোমধ্যে হাজারখানেক মানুষকে জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা করা নিয়ে আপত্তি নেই। যেভাবে ধরে আনা হচ্ছে, তা অবশ্যই আপত্তিকর।

এবার পুলিশের অভিযান চলছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত। এই রাস্তাটি আমার খুব প্রিয় আর পরিচিত। একসময় টিএসসি থেকে হেঁটে হেঁটে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এসেছি বহু। ভোরের কাগজে কাজ করার সময় বাংলামোটর এলাকার রাস্তায় হেঁটেছি অনেক। অনেকদিন পর আজ ইকবাল রোডের বাসা থেকে হেঁটে অফিসে এসেছি। প্রথমেই বলে নিই, আমার হাঁটার অভিজ্ঞতা মিশ্র। ঢাকার সবচেয়ে চওড়া রাস্তা মানিক মিয়া এভিনিউর দুই পাশেই মন ভালো করে দেয়া সবুজের সমারোহ। কিন্তু খেজুরবাগান থেকে ফার্মগেট হয়ে অফিসে আসার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। আমার ধারণা ছিল, পথচারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর আগে ফুটপাত পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু মাঠে নেমে দেখলাম পথচারীদের সচেতন না করেই, তাদের জন্য ফুটপাত তৈরি না করেই অফিসগামী ব্যস্ত লোকদের কলার বা বেল্ট ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে পুলিশ। খেজুরবাগান থেকে ফার্মগেটের দিকে আসতে আমাকেও গাড়ির সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে হয়েছে। কোনো বিকল্প ছিল না। ফার্মগেট পার্কের দক্ষিণ দিকের রাস্তার একপাশে ভাসমান বস্তি, আরেক পাশ জুড়ে বাজার। যেখানে সুঁই থেকে সবজি সবই পাওয়া যায়। ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজ যেন সেই বাজারের এক্সটেনশন। ঢাকা মহানগর পুলিশের স্মার্ট কমিশনার বেনজির আহমেদ বলেছেন, ‘মানুষ যদি রাস্তায় না হেঁটে ফুটপাতে হাঁটে তাহলে সেখানে আর হকার বসতে পারবে না।”
কমিশনার সাহেব যদি একদিন ছদ্মবেশে ফার্মগেট থেকে খেজুরবাগান মোড় পর্যন্ত হেঁটে যান, তাহলেই বুঝবেন, তার এই আবদার কত অবাস্তব। ফুটপাতে যারা বসেন, তারা কি আর মানুষের অনুমতি নিয়ে বসেন? তাদের নিয়মিত পুলিশ এবং স্থানীয় মাস্তানদের টাকা দিতে হয়। মানুষ ফুটপাতে হাঁটলেই হকাররা সরে যাবে, ভাবনাগুলো অত সরল নয়। কমিশনার সাহেব কি বোকা না অতি চালাক, নাকি তিনি খোঁজ রাখেন না?

ফার্মগেট থেকে কারওয়ানবাজার ফুটপাত পুরোপুরি হাঁটার উপযোগী নয়। মাঝে মাঝেই খোলা ম্যানহোল। আকাশ দেখার সাধ হলে আপনি বিনা পয়সায় বুড়িগঙ্গা চলে যেতে পারবেন। নিদেনপক্ষে মনুষ্যবর্জ্যে পা বাঁধানোর ঝুঁকি তো থাকেই। হাঁটতে হাঁটতেই আপনি শুনতে পাবেন মোটর সাইকেলের হর্ন। যেন ফুটপাত আপনার নয়, মোটর সাইকেলের। এটিএন নিউজের কল্যাণে কারওয়ানবাজার আন্ডারপাস বদলে গেছে প্রজাপতি গুহায়। রাজধানীর বাকি আন্ডারপাসগুলোর অবস্থা কি জানেন ডিএমপি কমিশনার? বাংলামোটরের ফুটওভারব্রিজটি যেখানে নেমেছে সেখান দিয়ে পথচারীদের হাঁটার কোনো উপায় নেই। রাজধানীর অনেক ফুটপাতে দোকানের মালামাল থাকে, অনেক ফুটপাতে ডাস্টবিন থাকে, অনেক ফুটপাতে ইট-সুড়কি থাকে, অনেক ফুটপাত দখল করে শ্রমিক লীগের অফিস থাকে।

হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আমরাও হাঁটতে চাই। তবে হাঁটাটা যেন হয় আনন্দের, ভয়ঙ্কর নয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমেদ অনেক স্মার্ট। তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বের অনেক দেশ দেখেছেন। আগে পথচারীর ফুটপাত পথচারীদের বুঝিয়ে দিন। তারপর অভিযান শুরু করুন।

প্রভাষ আমিন
[email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *