প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনারদের প্রতি তাদের কাজকে নিছক চাকরি হিসেবে না দেখে দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষার এক মহান দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, বিদেশে আপনারা একেকজন একেকটি বাংলাদেশ।
আপনাদের কাজ নিছক চাকরি করা নয়, আরো অনেক বড় এবং মহান কিছু। দেশের ১৬ কোটি মানুষের হয়ে আপনারা সেখানে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন আপনারা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব সময় দেশের স্বার্থে আপনাদের কাজ করতে হবে।
তিনি আজ রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে তিন দিনব্যাপী দূত সম্মেলনের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব দেশে আমাদের অধিকসংখ্যক প্রবাসী রয়েছেন, সেসব দেশে তাঁদের প্রতি আলাদা নজর দিতে হবে। তারা যাতে কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বিপদে-আপদে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই নেতিবাচক প্রচারণা হয়। উচ্চমানের পেশাদারিত্ব দিয়ে সেসবের মোকাবিলা করতে হবে।
আর এ জন্য নিজ দেশ, দেশের মানুষ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালনরত রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং স্থায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই দূত সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
বর্তমানের জটিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কি হবে সে বিষয়ে মতবিনিময়ের জন্যই এই সম্মেলনের আয়োজন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা প্রদান করেন।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিষয়ে রাষ্ট্রদূতদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা আমার দেশের নাগরিক, তাদের ভালো মন্দ দেখা, তাদের সুযোগ-সুবিধা দেখা, অসুবিধাগুলো দূর করা- এটা কিন্তু আপনাদের কর্তব্য।
তিনি বলেন, সেই হিসেবে প্রতিটি রাষ্ট্রদূতকে আমি অনুরোধ করব আপনারা যেখানেই থাকেন অন্তত আমাদের প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে সপ্তাহ বা মাসে একটা দিন সময় দিয়ে তাদের সমস্যাগুলো শুনবেন এবং সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেবেন।
এ সময় তিনি বলেন, এটা ভুলে গেলে চলবে না তারাই কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করে এবং তারা যে টাকা পাঠায় সেটাই আমাদের রিজার্ভের একটা বড় অংশ। অর্থনীতিতে তারা বিরাট অবদান রাখছে। আর আমরা যে এতগুলো কূটনৈতিক মিশন চালাচ্ছি তার সিংহভাগ উপার্জন কিন্তু তারা করছে। কাজেই সে ক্ষেত্রে তাদের একটা গুরুত্ব আমাদের কাছে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানে বেশি জনসংখ্যা রয়েছে সেখানে তাদের জন্য স্কুল করা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ আমাদেরকে নিতে হবে।
তিনি বলেন, আমি জানি বিদেশে দূতাবাসে কাজ করতে প্রায়শই বিভিন্ন কারণে সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। আমার সরকার বিদেশে দূতাবাসের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সব সময় চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন, আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি কর্মচারিদের বেতন-ভাতা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছি। বৃদ্ধি করা হয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। প্রশাসনের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে হয় এদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ১১৬টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ১২টি দেশে নতুন দূতাবাস স্থাপনসহ নতুন ১৭টি মিশন খোলা হয়েছে। ২০১২ সালে বৈদেশিক ভাতা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি এবং সন্তানদের শিক্ষাভাতা বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষাভাতা প্রাপ্তির উর্ধ্বসীমা ২৩ বছর করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় সর্বপ্রথম দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক এটি আমার আন্তরিক প্রত্যাশা। দক্ষিণ এশিয়াকে শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বসবাস করার ক্ষেত্রে আমরা সকলের সঙ্গে সহযোগিতা করব। বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্য ছিল ঐতিহাসিক ও দূরদর্শী। বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতার ধারণার উপর ভিত্তি করেই আমার সরকার এই অঞ্চলের দেশসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি নতুন মডেল প্রণয়ন করেছে।
আমরা আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা সাফল্য অর্জন করায় সমগ্র বাংলাদেশ এখন ইন্টারনেট প্রযুক্তির আওতায় এসে গেছে। আমরা প্রতিবেশি দেশগুলোতেও আমাদের সাবমেরিন কেবল থেকে ব্যান্ডউইথ রপ্তানী করতে পারছি। আমরা সহসাই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছি সেখান থেকেও নানা সুযোগ-সুবিধা আমরা পাশ্ববর্তী দেশে সরবরাহ করে এর সুবিধা নিতে পারবো বলে আশা করছি।
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে তিনি আরো সজাগ থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, যে সমস্ত দেশ এই ইস্যুতে আমাদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদের সেই বিষয়গুলোও দেখে সরকার। তবে, আমরা কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকিনি ‘কপ-১৫’ এর পর আমরা দেশে এসে নিজস্ব বাজেটে ফান্ড তৈরি করে এটা মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছি।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রশ্নে সরকারের জিরো টলারেন্সনীতির পুনরোল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এই মাটিতে কোনরকম জঙ্গিবাদ আমরা হতে দেব না। আমাদের ভূখণ্ডকে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্যও আমরা ব্যবহার করতে দেব না। আমরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান চাই।
শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, বাংলাদেশটা যে একটা অস্ত্র চোরাকারবারীর রাস্তা হবে বা এখানে শিশু পাচার, নারী পাচার, মাদক পাচার হবে তা আমরা হতে দেব না। এগুলোকে বন্ধের জন্য যা যা করণীয় আমরা তা করবো এবং সেটা করতে গেলেও আমাদের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যেমন সুসম্পর্ক দরকার তেমনি তাদের সহযোগিতাও দরকার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। তবে, এবার আমাদের পর পর কয়েকদফা বন্যায় খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে গেল, আমরা সঙ্গে সঙ্গেই বিদেশ থেকে খাদ্য কিনে সেই সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নিয়েছি এবং ভবিষ্যতে যেন আরো উৎপাদন বারে তারও উদোগ নিয়েছি।
তিনি বলেন, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বিদেশে পণ্য রপ্তানীর বিষয়ের দিকে আমরা বার বার নজর দিতে চাচ্ছি এজন্য এসব পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্যও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় ঘুরে ফিরে আসে প্রবাসি বাঙালিদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা এবং দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রদূতদের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি।
উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আন্তসংযোগ বা কানেকটিভিটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বিদেশী বিনিয়োগের নিশ্চয়তা বাড়ানো, অধিকতর বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশের পণ্যের জন্য নিত্য নতুন বাজারের সন্ধান করা, প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রয়োজনীয় পরিসেবা প্রদান এবং তাদের দক্ষতা ও জ্ঞানকে দেশের স্বার্থে কাজে লাগানো এবং আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং আইসিটি ও সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের ৯ দফা নির্দেশনাও রাষ্ট্রদূতদের প্রদান করেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করা এবং খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করার বিষয়েও রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা পালনের আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।
যুদ্ধরাপরাধীদের এবং জাতির পিতার খুনীদের বিচারের প্রসঙ্গ উল্লেখ কওে তিনি বলেন, আপনারা জানেন, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে জাতির পিতার খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার ও দুঃখজনক। এরচেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হয় না। কূটনৈতিক মিশনে চাকরী পাবার যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল তারা জাতির পিতার হত্যাকারী। একটা দেশের রাষ্ট্রপতিকেই শুধু নয় তারা নিরাপরাধ শিশু ও নারী হত্যাকারি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ইনডেমনিটি অর্র্ডিন্যান্স বাতিল করে সেই খুনীদের বিচার করে বিচারের রায় কার্যকর করেছি। তবে, এসব খুনীরা এখনও বিভিন্ন দেশে রয়ে গেছে (পলাতক)। তারা বসে নেই এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আর একাত্তরে গণহত্যাকারীরা বিভিন্ন দেশে যারা রয়ে গেছে তারা নানা ধরনের অপপ্রচার দেশের বিরুদ্ধে চালাচ্ছে। পাশাপাশি কিছু সংস্থাও আছে।
প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রদূতদের বলেন, এই বিষয়টা আপনাদের লক্ষ রাখতে হবে এই যে অহেতুক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে সেই দিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে এবং যেটা বাস্তব সেটি যেন সেসব দেশগুলোতে তুলে ধরা যায় আপনারা সেদিকে দৃষ্টি দেবেন। এসব অপপ্রচার করে কোনোভাবেই যেন তারা আমাদের দেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করতে না পারে।
সূত্র : বাসস