এই অবহেলা মেনে নেওয়া যায় না
ফকির আলমগীর
বারী সিদ্দিকী কেবল একজন সুরকার আর লোক সংগীতশিল্পী নন, একজন গবেষকও। ৩১ বছর ধরে তিনি টেলিভিশনে কাজ করেছেন। তিনি এবার হাসপাতালে যখন চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন আমি অনেককেই তাঁকে একনজর দেখতে যাওয়ার জন্য বলেছি। আজ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। একদিন সবাইকে যেতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ আর বিটিভির জানাজায় উল্লেখযোগ্য মানুষের অংশগ্রহণ আশা করেছিলাম। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদেরও আশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমিই দেরি করে এসেছি। সারা জীবন যে শিল্পের সাধনা করলাম, এটাই আমাদের পাওনা? এই অবহেলা মেনে নেওয়া যায় না। এক জীবনে তিনি বহু মঞ্চ আলোকিত করেছেন। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি অবহেলা আর সঙ্গের শিল্পীদের এখানে না দেখে হতাশ হয়েছি। যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন, যাঁদের কণ্ঠে সুর তুলে দিয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে বিদেশ সফর করেছেন, সেই শিল্পীদের দেখতে না পেয়ে আমি হতাশ হয়েছি।
আমরা প্রয়াত এই শিল্পীকে নিয়ে ফেসবুক, টিভি টক শো এবং পত্রিকায় ঠিকই বিবৃতি দেব, স্মৃতিচারণা করব, অথচ এই শিল্পীর শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠানিকতায় নেই! তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য গান করেছেন। কিন্তু তাঁকে আমরা সঠিকভাবে বিদায় দিতে পারিনি। এটা আমাদের এবং জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। আজকাল মরণোত্তোর অনেক পুরস্কার হয়। আমার মনে হয়, বারী সিদ্দিকীকে মূল্যায়ন করতে পারিনি।
তাঁকে ঠিকভাবে বিদায় জানাতে পারিনি
মানাম আহমেদ
গত শতকের নব্বই দশক থেকে বারী ভাইয়ের (বারী সিদ্দিকী) সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তখন তিনি বংশীবাদক ছিলেন। পরিচয়ের শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি গুণী মানুষ। কিন্তু কেন জানি কেউ তা বুঝতে পারেনি। তিনি গানে একটা নতুন ধারার সঙ্গে সবাইকে পরিচিত করেছেন। যখন তিনি বাঁশি বাজাতেন, তখনো তিনি একই ধরনের চেষ্টা করতেন। তাঁর সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। তাঁর গুণের কথা বলে শেষ করতে পারব না। বাঁশির পাশাপাশি বারী ভাই যখন গান গাইলেন, গান নিয়ে নিরীক্ষা শুরু করলেন, নতুন ধারার সঙ্গে আমাদের পরিচিত করেছেন। বারী সিদ্দিকীর আসল রূপ আমরা পেয়েছি তাঁর গান শোনার পর। যা-ই হোক, একজন গুণী মানুষকে অসময়ে হারাতে হলো। এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারিনি, ঠিকভাবে বিদায় জানাতে পারিনি।
স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়ছে
নকিব খান
সুর, গাওয়া ও বাঁশি বাজানো—এই তিন ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। তাঁর কণ্ঠ একেবারেই অন্য রকম। তিনি যে লোকগান করতেন, যে দরদ দিয়ে গাইতেন, এটা বিরল। তিনি আমাদের যে গানগুলো দিয়ে গেছেন, তা অমূল্য সম্পদ। তিনি উকিল মুন্সির অনেক গান গেয়েছেন, সেগুলো খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সংগীতাঙ্গনে তিনি অনেক অবদান রেখেছেন। তাঁর অভাব কোনো দিন পূরণ হবে না। লোকগানে তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
আমাদের রেঁনেসা ব্যান্ডের দ্বিতীয় অ্যালবাম প্রকাশ হয় ১৯৯২ সালে। এর তিন বছর পর তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাদের ৪ নম্বর অ্যালবামের দুটি গানে বাঁশি বাজিয়েছিলেন। আমাদের সঙ্গে কাজটি তিনি উপভোগ করেছিলেন। এই অ্যালবামে কাজ করতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে তাঁর দারুণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখন সেই সময়ের স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়ছে।
এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা
জালাল
বাবা ছাড়া অন্য কারও কাছে আমার বাঁশি শেখা হয়নি। কিন্তু এক অনুষ্ঠানে ‘রজনী তুই হইস না অবসান’ গানটি কীভাবে তুলতে হবে, বারী ভাই (বারী সিদ্দিকী) তা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। তাঁর মানের বংশীবাদক বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই।
আমি ওস্তাদকে হারিয়েছি
নোলক
আমার ‘দুই চোখের কাঁন্দন’ অ্যালবামের সবগুলো গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন বারী স্যার। আর কথা লিখেছিলেন শহীদুল্লাহ ফরায়জি স্যার। ‘ক্লোজআপ তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় চ্যম্পিয়ন হওয়ার পর এই অ্যালবামের কাজ শুরু করি। গানগুলো করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। ওই সময় তিনি আমাকে কিছু অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। যখন অ্যালবামের কাজ করেছিলাম, টানা এক মাস আমাদের দেখা হয়েছিল। আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে গানগুলোর সুর আর সংগীত করতেন। সন্তানকে যেভাবে আদর করতেন, ঠিক সেভাবে আমাকে স্নেহ করতেন। আমাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন।
‘ক্লোজআপ তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগেই আমি তাঁর গাওয়া গান গাইতাম, এখনো গাইছি। তিনি আমার প্রিয় শিল্পী। আমার ওস্তাদ। আমার গুরু। আমি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শুনি বারী স্যারের গান। ‘ক্লোজআপ তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর আগে যখন আমি জামালপুরে থাকতাম, তখন থেকেই তাঁর গান শুনতাম। বারী স্যারের প্রথম অ্যালবাম আমি যখন কিনি, আমার বাসায় তখন সিডি প্লেয়ার ছিল না। ওয়াকম্যানে গান শুনতাম। আমি ওস্তাদকে হারিয়েছি।