হাতিরঝিলে নর্দমার ময়লা

Slider ঢাকা

1a24d0b78c0678ec187ff79ac67fec9f-5a164d8f580c5

 

 

 

 

 ঝিলের পানি দুর্গন্ধময়, ১০টি পথে পানি ও বর্জ্য আসে এখানে

 একটি পথে পৃথক পয়োনালা হচ্ছে, বাকি ৯টি তৈরির উদ্যোগ নেই

নয় বছরের বালক উল্লাসের এক হাত দাদুর হাতে ধরা, আরেক হাত নাকে। সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে হাতিরঝিলের পাড়ে সে পায়ে চলার পথ ধরে হাঁটছিল।

নাক ধরেছ কেন?

উল্লাসের সরাসরি জবাব—পচা গন্ধ।

দাদু কবির উদ্দিন ইস্কাটনের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। রোজকার মতো সেদিন বিকেলেও নাকে রুমাল চেপে হাঁটছিলেন। তিনি নাতিকে বুঝিয়েছেন, শরীর ভালো রাখতে হলে খোলা হাওয়ায় হাঁটাচলা করতে হবে। কিন্তু এই দুর্গন্ধময় বাতাসে শরীর উল্টো খারাপ হয়ে যেতে পারে বলে তাঁর মনে হচ্ছে।

প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ ও উন্নয়ন শেষে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। পরে যোগ হয় আরও ৫০০ কোটি টাকা। ঝিলের ঝকঝকে হাঁটা পথ, সড়ক আর বাঁধানো পাড়ের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। কিন্তু দূষণের কারণে ঝিলের পানির অবস্থা করুণ।

জানতে চাইলে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি উন্নয়ন প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পানির দূষণ কীভাবে কমবে? বাসাবাড়ির মলমূত্র, শিল্পবর্জ্য—সবই তো পড়ছে হাতিরঝিলে।’

ধানমন্ডি লেকের মতো হাতিরঝিল কোনো বদ্ধ জলাশয় নয়। এটি বৃষ্টির পানির একটা প্রাকৃতিক প্রবাহপথ। হাতিরঝিলের কর্তৃপক্ষ সংস্থা রাজউক সূত্রে জানা যায়, যে ১০টি পথে এখানে আশপাশের এলাকার বৃষ্টির পানি এসে পড়ে, ওই পথগুলোর সঙ্গে শহরের পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যের সংযোগ আছে। শহরের পয়োনালা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এসব এলাকায় আলাদা পয়োনালা তৈরির কথা থাকলেও তা করেনি। ফলে হাতিরঝিলের বাহ্যিক সৌন্দর্য যতই বাড়ানো হোক, এটির পানি আগের মতোই দুর্গন্ধময় রয়ে গেছে।

বর্তমানে সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে আলাদা পয়োনালা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু ঝিলে পানি প্রবেশের অপর নয়টি পথ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। যেসব এলাকায় এই নয়টি পথ আছে সেগুলো হলো—মগবাজারের টঙ্গী ডাইভারশন রোড, মধুবাগ, বেগুনবাড়ি, নিকেতন, তেজগাঁও, বাড্ডা ও রামপুরায় একটি করে। আর মহাখালীতে আছে দুটি পথ। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব পথে সব ধরনের তরল বর্জ্য লেকে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, চারপাশের ১০টি পথে বৃষ্টির পানির পাশাপাশি পয়োবর্জ্যও গিয়ে পড়ছে হাতিরঝিলে। শুধু একটি নির্গমন পথ থেকে আলাদা পয়োনালা করলে দূষণের মাত্রা কমানো কিংবা সুফল পাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই সব কটিই করতে হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘হাতিরঝিলে পয়োবর্জ্য গিয়ে পড়ছে, এটা ঠিক নয়। অন্তত আমার এ তথ্য জানা নেই। এই পথে বৃষ্টির পানিই শুধু যায় বলে জানি।’

সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে কী হচ্ছে?

হাতিরঝিলের সোনারগাঁও হোটেলের পেছনের অংশে যায় কলাবাগান, গ্রিন রোড, পান্থপথ, কাঁঠালবাগান ও আশপাশের এলাকার সব ধরনের বর্জ্য। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুরো লেকে নানা ধরনের বর্জ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। লেকের এক পাশে কঠিন বর্জ্য আটকানোর জন্য বৈদ্যুতিক ছাঁকনি (মেকানিক্যাল স্ক্রিন) আছে, কিন্তু সেটি বন্ধ। পেছনে লেকের পাড়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে আগে আটকা পড়া পলিথিনসহ নানা বর্জ্য। পায়ে চলার পথের কাছে লেকের ধারেও জমে আছে বর্জ্য।

হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের উপস্থিত একজন কর্মকর্তা বলেন, বৃষ্টির পানি ও তরল বর্জ্য যাওয়ার এখানে আলাদা পাইপলাইন করা হচ্ছে। বর্তমানে কাঁঠালবাগানে সুন্দরবন হোটেলের পেছনে এবং ঝিলপাড়ে এটির নির্মাণকাজ চলছে। গ্রিন রোড ৮ নম্বর সড়ক থেকে রামপুরা পর্যন্ত মোট তিন কিলোমিটার পয়োলাইন হবে।

 

বাকি নয়টি পথের উদ্যোগ নেই

টঙ্গী ডাইভারশন রোডের পূর্ব দিকে মগবাজার উড়ালসড়কের পাশে মধুবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পানি প্রবেশের পথ বেয়ে তরল বর্জ্য সরাসরি লেকে পড়ছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা শরাফত আলী জানান, বৃষ্টি হলে পানির তোড় অনেক বেড়ে যায়। সেখানেও একটি ছাঁকনি বন্ধ অবস্থায় রয়েছে।

লেকের বেগুনবাড়ি প্রান্তে আরেকটি পথেও অনর্গল তরল বর্জ্য ঢুকছে। সেখানে ঢাকনা উঠিয়ে রাখা একটি ম্যানহোল দিয়েও ময়লা পানি বেরোচ্ছিল। ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, এই পথে বেগুনবাড়ি এলাকার পয়োবর্জ্য আর তেজগাঁওয়ের শিল্পবর্জ্য ঢোকে।

নিকেতনে পুলিশ প্লাজার পশ্চিমে হাতিরঝিলমুখী গেটের ডান পাশেই রয়েছে পানি প্রবেশের একটি পথ। ওয়াসা সূত্র জানায়, এই পথে নিকেতনের পুরো এলাকার পয়োবর্জ্য ও গৃহস্থালি বর্জ্য হাতিরঝিলে গিয়ে পড়ে। তবে ঘেরাও দেওয়ায় বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। রামপুরা সেতুর গোড়ায় মহানগর প্রকল্প প্রান্তের পথ দিয়েও একইভাবে ঝিলে তরল বর্জ্য যেতে দেখা যায়। মহাখালী বাস টার্মিনালের পেছনে এবং রসুলবাগ এলাকায় মহাখালী খালপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, বারোয়ারি বর্জ্য ছড়িয়ে আছে।

রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায়, হাতিরঝিলে পানি প্রবেশের সব পথ পয়োবর্জ্যমুক্ত করতে আলাদা পয়োনালা নির্মাণ করতেই হবে। এ জন্য কয়েক দিন আগে পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে ওয়াসাকে অনুরোধও করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী এবং হাতিরঝিলে ওয়াসা অংশের প্রকল্প পরিচালক মো. মামুন বলেন, বাকি আউটলেটের স্থানে আলাদা পাইপলাইন কবে নাগাদ করা হবে, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে যখনই হয়, ওয়াসা থেকেই হবে। এ ছাড়া জায়গা কম থাকায় সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে এবং অন্য কোথাও ইটিপি করা সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *