ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছেন জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী।
দেড়শ’ পৃষ্ঠার মূল আপিলসহ ১ হাজার ৭৫০ পৃষ্ঠার আপিলে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছেন মীর কাসেম আলী।
রোববার (৩০ নভেম্বর) আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল আবেদন দাখিল করেন মীর কাসেমের আইনজীবীরা। এ আপিলের তথ্য নিশ্চিত করেছেন তার আইনজীবী শিশির মুহাম্মদ মুনির।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মীর কাসেম আলীকে গত ২ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-২।
আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও মরদেহ গুম এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলী। এ ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়েছে। বাকি ৪টি অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।
১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অর্থাৎ ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং ৪টি অর্থাৎ ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ মোট ৮ জনকে হত্যার দায়ে কাসেমের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ১১ নম্বর অভিযোগে সর্বসম্মত ও ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ফাঁসির রায় দিয়েছেন বিচারপতিরা।
ফাঁসি ছাড়াও প্রমাণিত অন্য ৮টি অভিযোগে আরও ৭২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা মীর কাসেম আলী। এর মধ্যে প্রমাণিত ২ নম্বর অভিযোগে ২০ বছর, ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর এবং ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। প্রমাণিত না হওয়া ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগে খালাস পেয়েছেন মীর কাসেম আলী।
৮ হত্যাকাণ্ডে ফাঁসি
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩ (২) (এ) (জি)/৪ (২) ধারায় আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ ছাড়া বাকি সব কটি অভিযোগেই অপহরণ এবং নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে। ওই দুই অভিযোগে মোট ৮ জনকে হত্যার দায়ে ফাঁসির আদেশ পেয়েছেন মীর কাসেম আলী। এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে ও ১২তম অভিযোগে রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজুকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
১১তম অভিযোগে বলা হয়েছে, রমজানের ঈদের পরে যেকোনো দিন মীর কাশেমের নির্দেশে শহীদ জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে অপহরণের পর ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। এতে জসিমসহ অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচজন শহীদ হন এবং পরে তাদের লাশ গুম করা হয়।
১২তম অভিযোগে বলা হয়েছে, মীর কাসেমের নির্দেশে নভেম্বর মাসের যেকোনো একদিন হাজারী গলি থেকে অপহরণ করে নির্যাতন করা হয় জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজুকে। এতে রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজু শহীদ হন এবং তাদের লাশ গুম করা হয়। নির্যাতনে গুরুতর আহত হন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
ফারুককে অপহরণ-নির্যাতনে ২০ বছর
দ্বিতীয় অভিযোগে লুৎফর রহমান ফারুককে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে ও সার্কিট হাউজে নিয়ে নির্যাতন করার দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে মীর কাসেম আলীকে।
এ অভিযোগে বলা হয়েছে, মীর কাসেমের নেতৃত্বে ১৯ নভেম্বর চাক্তাই থেকে লুৎফর রহমান ফারুককে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে ও সার্কিট হাউজে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং তার বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় সিরাজ (বর্তমানে মৃত) নামক অন্য একজনকেও নির্যাতনে আহত হন। লুৎফর রহমান ফারুককে পরে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
১০ বছর নাসিরকে নির্যাতনে
নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনা সর্বশেষ অর্থাৎ ১৪তম অভিযোগে। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে দেওয়া হয়েছে ১০ বছরের কারাদণ্ড।
এ অভিযোগে বলা হয়েছে, মীর কাসেমের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে যেকোনো একদিন গভীর রাতে নজির আহমেদ চৌধুরী রোড থেকে নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।
৬ অভিযোগে আরও ৪২ বছর
প্রমাণিত হওয়ায় অন্য ৬টি অভিযোগও ছিল অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত। ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে এসব অপরাধের দায় প্রমাণিত হওয়ায় ৭ বছর করে আরও ৪২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে মীর কাসেমকে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ২২ বা ২৩ নভেম্বর মীর কাসেমের নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তার ডবলমুরিং থানার কদমতলির বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ডবলমুরিং থানার আজিজ কলোনির বাসা থেকে সাইফুদ্দিন খানকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল নির্যাতন কেন্দ্রে নির্যাতন করে আলবদর বাহিনী। পরে তাকে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুনুর রশিদকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল এবং সালমা মঞ্জিল নির্যাতনকেন্দ্রে নির্যাতন করা হয়।
সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, মীর কাসেমের নেতৃত্বে সাত/আট যুবক ডবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও ইলিয়াসকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয় ডালিম হোটেলে।
নবম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৯ নভেম্বর নুরুজ্জামান নাজিরবাড়ি থেকে সৈয়দ মো. এমরানসহ সাতজনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। অন্য ছয়জন হচ্ছেন- এস এম জামাল উদ্দিন, এস এম সারওয়ার উদ্দিন, এস এম কামাল উদ্দিন, এস এম ওসমান, এস এম গোলাম কিবরিয়া ও সৈয়দ মোঃ গোলাম কিবরিয়া।
দশম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৯ নভেম্বর মীর কাসেমের নির্দেশে গোলাম আলী নাজিরবাড়ি থেকে মোঃ জাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরণ করে নিয়ে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। অন্য তিনজন হচ্ছেন- মোঃ সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়া, ইস্কেন্দার আলম চৌধুরী ও মোঃ নাজিম উদ্দিন।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, কাসেম আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ওই সময় চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম শহর শাখারও সভাপতি ছিলেন।
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মীর কাসেম আলী জামায়াতসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের সমন্বয়ে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করেন। সেই আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী স্বাধীনতাবিরোধী মূল ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে সারা বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।
চট্টগ্রাম শহরের দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিং (চামড়ার গুদাম), সালমা মঞ্জিল, ডালিম হোটেলসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে মীর কাশেম আলী তার সহযোগীদের নিয়ে আলবদর বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এসব নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে বহু মানুষকে ধরে নিয়ে তিনি দিনের পর দিন নির্যাতন এবং অনেক লোককে হত্যা করেন।
প্রমাণিত না হওয়া ৪ অভিযোগ
প্রমাণিত না হওয়া বাকি ৪ অভিযোগও ছিল অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত। ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বরে আনা এসব অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল এসব অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছেন।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, মীর কাসেমের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর ওমর-উল ইসলাম চৌধুরীকে অপহরণ করে। পরে কয়েক দফায় চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেল, পাঁচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল এবং কোতোয়ালি থানার দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের চামড়ার গুদাম এবং পাঁচলাইশ থানার চাক্তাই সাম্পানঘাট নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতনে আহত করা হয় তাকে। পরে জোর করে স্বাক্ষর রেখে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৫ নভেম্বর আনোয়ারা থানার আবদুল জব্বারকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে নির্যাতন করা হয়। পরে ডালিম হোটেলে মীর কাসেমের সামনে হাজির করা হয়। সেখানে নির্যাতন করা হয় তাকে।
অষ্টম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৯ নভেম্বর রাতে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় নুরুল কুদ্দুস, মোঃ নাসির ও নুরুল হাশিমকে।
১৩তম অভিযোগে বলা হয়েছে, মীর কাসেমের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে যেকোনো একদিন সুনীল কান্তি বর্ধন দুলালকে অপহরণ করে। পরে কয়েক দফায় ডালিম হোটেল, সালমা মঞ্জিল এবং দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের চামড়ার গুদাম এবং চাক্তাই সাম্পানঘাট নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতনে আহত করা হয় তাকে ।