ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাহুল গান্ধী যে আগামী মাসেই দায়িত্ব নিচ্ছেন, তা সোমবার একরকম নিশ্চিত হয়ে গেল।
দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ৪ঠা ডিসেম্বর দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ দিন – যার অর্থ দাঁড়ায়, রাহুল গান্ধীকে কেউ চ্যালেঞ্জ না করলে সে দিনই তিনি নতুন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন।
গত ১৯ বছর ধরে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের পদে আছেন তার মা সোনিয়া গান্ধী, এখন নেতৃত্বে রাহুল এলে নেহরু-গান্ধী পরিবারের পঞ্চম প্রজন্ম হিসেবে তিনি দলের ভার সামলাবেন।
সাতচল্লিশ-বছর বয়সী রাহুল গান্ধী উত্তরপ্রদেশের আমেথি থেকে নির্বাচিত এমপি টানা সাড়ে ১৩ বছর ধরে, তিনি কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তাও চার বছরের ওপর হল।
বেশ কিছুদিন ধরে সোনিয়া গান্ধীর শরীর ভাল যাচ্ছে না, তাই রাহুল যে কোনদিন দলের নেতৃত্বে আসবেন – গত কয়েক বছর ধরে চলা এই জল্পনার অবশেষে পাকাপাকি অবসান হল।
ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পর দল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল, নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়ার জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাচ্ছে ১লা ডিসেম্বর থেকেই।
দলের ভেতর রাহুল গান্ধীকে কেউ চ্যালেঞ্জ করবেন সেই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ – ফলে খুব সম্ভবত গুজরাট ভোটের আগে ৪ঠা ডিসেম্বরেই তার অভিষেক সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
আর যদি নিয়মরক্ষার কোনও নির্বাচন হয়ও, তাহলে ‘কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী’ বলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীরজা চৌধুরীর কথায়, “এটা একরকম প্রত্যাশিতই ছিল – যদিও আমি বলব রাহুল এই বুঝি দায়িত্ব নিলেন, এই জল্পনাটাও বড্ড বেশি দিন ধরে চলেছে। রাহুল শেষ পর্যন্ত এমন একটা সময়ে আসছেন যখন দলের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়, লোকসভায় তাদের মাত্র ৪৪জন এমপি। ”
“কিন্তু এটাও ঠিক হাওয়া কিছুটা বদলানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, আর গুজরাটেই তা স্পষ্ট।
লোকে আগে যেভাবে রাহুলকে এক কথায় খারিজ করে দিত তা আর তারা করছেন না, পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদীর বিরাট জনপ্রিয়তা থাকলেও বিজেপিকে নিয়েও লোকে কিন্তু প্রশ্ন তুলছে। ”
রাহুল গান্ধী রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ব, দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আদৌ সিরিয়াস নন – বিজেপি বহুদিন ধরেই তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে আসছে, তাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছে ‘পাপ্পু’ বলে – যার অর্থ মূর্খ।
সোমবার কংগ্রেসে তার পদোন্নতি ঘোষণার দিনেও বিজেপি কটাক্ষ করেছে কংগ্রেসের বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব নিয়ে।
ক্যাবিনেট মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলছেন, “নেতৃত্বে আসছেন খুব ভাল কথা – এখন খাটাখাটনি করুন, তারপর দেশের জনতাই বিচার করবে কেমন করলেন না করলেন। আর দলের মধ্যে যেভাবে রাহুলের জন্য কোরাস বাজছিল তাতে এ তো হওয়ারই ছিল – যদিও কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। ”
“কিন্তু আমাদের প্রশ্ন একটাই, আমাদের দলে যেভাবে অমিত শাহ-নীতিন গডকড়িরা বুথ পর্যায় থেকে উঠে এসে দলের সভাপতি হয়েছেন কংগ্রেসে সেটা কি কখনও সম্ভব, না কি এই পদটা শুধু এক বিশেষ পরিবারের জন্যই সংরক্ষিত?”
রাহুল গান্ধীর কাজের ধারা যে ব্যতিক্রমী এবং সে কারণে অনেকেই তাকে হয়তো ভুল বোঝেন – তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও সে কথা অস্বীকার করেন না।
রাহুলের তরুণ ব্রিগেডের সদস্য ও মালদা এলাকার এমপি মৌসম বেনজির নূর বিবিসিকে বলছিলেন, “যুব কংগ্রেসে ও পার্লামেন্টে তার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে দেখেছি রাহুলজী অন্য নেতাদের চেয়ে একদম আলাদা। নতুনদের সুযোগ দেন তিনি, তার জন্যই পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যত্র কংগ্রেসের একেবারে ব্লক পর্যায়ের সাধারণ কর্মীরাও বিধানসভা নির্বাচনে দলের টিকিটে লড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ”
এটা ঠিকই যে রাহুল গান্ধীর ভঙ্গিমা, আবেগ বা প্যাশন, তথাকথিত অনভিজ্ঞতা – সব কিছুই বিতর্কের মালমশলা জোগায়। কিন্তু মানুষটির আন্তরিকতা, দূরদৃষ্টি নিয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই বলেই মনে করেন সহযোগী মৌসম বেনজির নূর।
মিস নূরের ধারণা, “রাহুলজী সোজাসাপটা কথা বলেন, সিস্টেমটা বদলানোর কঠিন লক্ষ্য নিয়ে নেমেছেন – কিন্তু কূটনীতির ধাঁচে ঘুরিয়েপেঁচিয়ে কথা বলা তার স্বভাব নয়। এই জন্যই মনে হয় অনেকে তাঁকে ভুল বোঝেন। ”
ভারতের রাজনীতিতে অনেক সময়ই রাহুল গান্ধীর এ ধরনের আচরণ দলের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে।
কিন্তু তারপরও কংগ্রেস তাকেই কার্যত পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিল, কারণ তাদের হাতে আর কোনও বিকল্প নেই – আর দেরি করার মতো হাতে সময়ও নেই।
– বিবিসি বাংলা