নীল ভেসপা ও একজন কাওসার স্যার

Slider খেলা

c3fac589f4e724bef007e414f8872111-5a138c39183f4

 

 

 

 

ঝড় হোক কিংবা বৃষ্টি, তপ্ত রোদ অথবা কুয়াশা ঢাকা শীতের সকাল—তাঁর দিনটা শুরু হতো একই রুটিনে; ভেসপা চালিয়ে কুয়াশার আড়মোড়া ভেঙে। প্রায় ৩১ বছর ধরে এ নিয়মেই চলে যাচ্ছিল তাঁর প্রতিদিন। কতজনের রঙিন স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর হাত ধরে। আবার চোখের কোণ ভিজে উঠেছে স্বপ্ন পূরণ না করতে পারা ছাত্রের কেঁদে ভাসানো দেখে। ঘাসের মাঠে কৃত্রিম টার্ফ বসেছে, বিকেএসপির লেকের ওপর পড়েছে কতশত সূর্যাস্তের আভা। সবকিছুরই সাক্ষী কাওসার আলী।

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) হকি বিভাগের সাবেক চিফ কোচ তিনি। এই যে অতীত কালের সুর টানা কিংবা খাতা-কলমের হিসাবে অতি সহজেই বলে দেওয়া ‘সাবেক’ কথাটি। মাত্র দুই দিন আগে (১৯ অক্টোবর), ৩১ বছরের বর্ণালি চাকরিজীবনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটেছে বাংলাদেশের হকি ইতিহাসের অন্যতম সফল এই কোচের।

১৯৮৭ সালে বিকেএসপির সূচনালগ্নে যোগদান করেন কাওসার আলী। মেঘে মেঘে বেলা পেরিয়ে চাকরিজীবন শেষে প্রতিষ্ঠানটির মায়া ছাড়তে হলো তাঁকে। হকির মহাগুরুর বিদায় সন্ধিক্ষণে এখন ডুকরে কাঁদছে খেলোয়াড় তৈরির কারখানাটি। আর শোনা যাবে না সেই ভেসপার শাসনের গর্জন। যেই শব্দ শুনলেই হোস্টেলের ছাত্ররা বুঝে যেত, ‘খুব সাবধান, কাওসার স্যার এসে পড়েছেন।’ ২০০১ ভর্তি ব্যাচের পরের ছাত্রছাত্রীরা কাওসার স্যারের নীল ভেসপার সঙ্গে পরিচিত। এর আগের ছাত্রদের কাছে আতঙ্কের নাম ছিল তাঁর নীল ইয়ামাহা হোন্ডা।

হকি মানেই বিকেএসপির আধিপত্য। হকি বিভাগটাকে কাওসার স্যার শক্ত হাতে ধরে রেখেছিলেন বলেই সুনামটা টিকে আছে এখনো। যেখানে শৃঙ্খলার অভাবে হকি ছাড়া প্রায় সব বিভাগই ধুঁকছে। বিদায় বেলায় এ একটা কথাই বারবার বললেন হকি গুরু, ‘আমি কখনোই শৃঙ্খলার সঙ্গে আপস করিনি। স্রোতের বিপরীতে গিয়েও চেষ্টা করে গেছি হকিটাকে আলাদা করে রাখতে।’

এবার এশিয়া কাপে খেলা পুরো বাংলাদেশ দলটিই ছিল বিকেএসপির ছাত্রদের নিয়ে তৈরি। আরও স্পষ্ট করে বললে পুরো দলটাই ছিল কাওসার আলীর ছাত্র। সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ও অধিনায়ক রাসেল মাহমুদ জিমি বিকেএসপি-১৯৯৮ (ক্লাস সেভেনে ভর্তি) ব্যাচের ছাত্র। আর সবচেয়ে কনিষ্ঠ বিপ্লব কুজুর ২০১২ ব্যাচের।

তারকাখ্যাতি না পেলেও জাতীয় দলে খেলেছেন কাওসার স্যার। আরও বড় একটি পরিচয় আছে তাঁর। হকির সঙ্গে জাতীয় ফুটবল দলেও খেলেছেন। ফুটবল ক্যারিয়ারটাই বর্ণিল। ১৯৭৮ থাইল্যান্ডে এশিয়ান গেমস ফুটবল খেলেছেন। দুই বছর পরেই কুয়েতে অনুষ্ঠিত হওয়া এশিয়া কাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বেও বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। তাই যশোরের এই গুণী মানুষটির কাছে কোচিং পেশা হিসেবে হকিকে বেছে নেওয়াটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিংই। অথচ বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত বছর এই কারিগরের হাতে উঠেছে এশিয়ান হকি ফেডারেশনের কোচিং ইনস্ট্রাক্টরের সার্টিফিকেট।

খেলোয়াড় তৈরির কারিগর হিসেবে তাঁর দ্বিতীয়টা খুঁজে বের করা কঠিন। এখন কোচ তৈরি ও গবেষণার দিকেই নজর বেশি তাঁর, ‘এখন অন্য জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এটাই বাস্তবতা। এখন হকি নিয়ে গবেষণা করব। কোচ তৈরি করার চেষ্টা করব। কোথাও খেলোয়াড় তৈরির সুযোগ পেলে সেটাও লুফে নেব।’ বোঝাই যাচ্ছে হকি দিয়েই সাজাচ্ছেন বাকি জীবনের পরিকল্পনা।

তাঁর বিদায় বেলায় অন্যতম এক প্রিয় ছাত্র জাতীয় দলের সাবেক হকি তারকা ও বর্তমান বিকেএসপির হকি কোচ মওদুদুর রহমান শুভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘১৯৯২ সালে যখন বিকেএসপিতে ভর্তি হই, তখন স্যার ছিলেন আমাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। স্যারের নীল রঙের ইয়ামাহা মোটরসাইকেল দেখলে বা তার শব্দ পেলেই সবাই সুবোধ ভদ্র বালক।’

নীল ইয়ামাহার জায়গাটা গত দেড় যুগ ধরে নিয়ে নিয়েছিল নীল ভেসপা। এই ভেসপা চড়েই মাঠ থেকে হোস্টেল—দিনের পর দিন শাসন করেছেন বিকেএসপি। নীলরঙা দুই চাকার একটা বাহনই যেন প্রতীক হয়ে উঠেছিল শাসন, শৃঙ্খলা ও ভালোবাসার।

আজ এই সবকিছুই শুধু গল্প হয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *