সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রের আনুকূল্যে। ফলে এখানে অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে।
আজ শনিবার রাজধানীতে ‘বাংলাদেশের নতুন মধ্যবিত্ত, গণতন্ত্র ও ধর্মের প্রশ্ন’ শীর্ষক এক সেমিনারে আকবর আলি খান এ কথা বলেন। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস-বিস) মিলনায়তনে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
আকবর আলি খান বলেন, ধর্ম নিয়ে হইচই শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই আছে। এটি দূর করা সম্ভব নয়। আবার এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ পুরোনো পথেই আছে। ফলে এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে। একটি হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট, অন্যটি হচ্ছে রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব। নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটছে। কিন্তু তারা ষাটের দশকের মধ্যবিত্তের মতো রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বা শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুৎসাহের কারণ কী? তারা কি গণতন্ত্রকে ভিন্নভাবে দেখছে? মধ্যবিত্তের কি রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই? ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের দিকে বাংলাদেশ যাচ্ছে কি না?’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দেশে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। একধরনের বেসামরিক কর্তৃত্ববাদ তৈরি হয়েছে। সামাজিক পরিমণ্ডলেও এটি ছড়িয়ে পড়েছে। এটা বড় সংকট।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত জাতীয় নির্বাচন একেবারে প্রশ্নবোধক নয়, তা তাঁরাও বলেন না। প্রশ্নবোধক, কারণ একটি বড় দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে হারলেও গণতন্ত্রের জন্য ভালো হতো। আগামী নির্বাচন যাতে সবার অংশগ্রহণে হয়, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র নয়, উন্নয়ন আগে, এটা আওয়ামী লীগের বক্তব্য নয়।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা এখন বাঞ্ছনীয়। বিষয়টিকে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে মধ্যবিত্তের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপান্তরই বর্তমান সংকটের কারণ।
নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হয় কীভাবে—এমন প্রশ্ন রেখে দৈনিক মানবজমিন-এর সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া কী হবে, কীভাবে নির্বাচন হবে, এটা ঠিক করা উচিত। বর্জনের সংস্কৃতি রাজনীতির ক্ষতি করছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এখন মুক্ত চেতনা নেই, তার কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থা। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে সাফল্য এসেছে। কিন্তু বৈষম্য ও বেকারত্ব বেড়েছে।
লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেমন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন, তা মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, এ দেশে সমন্বয়ের সংস্কৃতি ছিল হাজার হাজার বছর ধরে। এখন সেটা হয়তো কমছে। কিন্তু এ দেশ কখনো মৌলবাদীদের হাতে যাবে না।
সিজিএসের সভাপতি আতাউর রহমান বলেন, প্রকৃত নির্বাচন না হলে সরকার বৈধতার সংকট কাটাতে পারবে না। তিনি মনে করেন, গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা জরুরি।
অন্যদের মধ্যে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, অধ্যাপক আহরার আহমেদ, অধ্যাপক সাদেকা হালিম, সরওয়ার জাহান চৌধুরী, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন জিল্লুর রহমান।