বিশেষজ্ঞদের মত
► বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সুবাতাস
► ক্ষমতাসীনদের নমনীয়তাও প্রশংসনীয়
► তবে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি
► সহনশীলতার জানালা খুলে দিয়ে বন্ধ করা সমীচীন নয়
► নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথাও বলতে হবে
দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনের গুমোট পরিবেশ কিছুটা কেটে গিয়ে মৃদুমন্দ সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন পর বিচ্ছিন্ন কিছু বাধাবিপত্তি ছাড়া গত রবিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির শান্তিপূর্ণ বিশাল জনসভা; এর আগে এ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ এবং পথে পথে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি; সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপ; সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির প্রস্তুতি—এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ রকমটাই মনে করছেন।
তাঁদের মত, এ বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের নমনীয় মনোভাবও প্রশংসনীয়। পাশাপাশি এটাও বলা হচ্ছে, সহনশীলতার জানালা খুলে দিয়ে কিছু ক্ষেত্রে আবার তা বন্ধ করার চেষ্টা সমীচীন নয়। তবে কারো কারো মনে এমন আশঙ্কাও রয়েছে, রাজনীতিতে এই সুবাতাস সাময়িকও হতে পারে। যে নির্বাচনকে উপলক্ষ করে এই রাজনৈতিক উৎসাহ, তার জন্য এখনো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। কারণ নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কি না, রাজনীতিতে সহনশীল পরিবেশ আরো উন্নত হয়ে তা বজায় থাকবে কি না—সেসব প্রশ্নে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি।
বিএনপির রবিবারের জনসভায় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনের জন্য যেসব দাবি জানিয়েছেন, তা রাজনৈতিক এবং তাতে দলের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের সমর্থন ও সম্মতি ছাড়া এসব দাবি বাস্তবায়ন করানোর মতো সামর্থ্য বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেই। নির্বাচন কমিশনও সব দাবি পূরণের এখতিয়ার রাখে না।
কেউ বলছেন, বিএনপি অনেক দিন ধরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে; কিন্তু রবিবারের জনসভায় এর রূপরেখা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
খালেদা জিয়ার দাবিগুলো সম্পর্কে ক্ষমতাসীন নেতারা বলেছেন, এগুলো সংবিধানবহির্ভূত এবং বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাও গত ২৬ অক্টোবর সংলাপোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সংসদ ভেঙে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে আইন সংশোধনে বাধ্য করার বা চাপ সৃষ্টির কোনো সুযোগ নির্বাচন কমিশনের নেই। আর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিবদমান ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কোনো উদ্যোগও নির্বাচন কমিশন নেবে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে বিদ্যমান আইনে কোনো পরিবর্তন আনারও দরকার নেই। যে আইন রয়েছে তাই যথেষ্ট। সরকার যে আইন তৈরি করে দেয়, ইসি সে আইনেই নির্বাচন করে। সে আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইসিকে সংবিধান মেনে চলতে হয়।
একজন নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত না করেও কার্যকরভাবে সেনা সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে তিনি সিআরপিসির ১৩১ ধারা উল্লেখ করে বলেছেন, এই বিধানের বলে প্রয়োজনে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতে সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ড অফিসারও জননিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর অবৈধ সমাবেশ ভঙ্গের নির্দেশ দেওয়ার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারের অধিকার রাখেন। এ প্রস্তাবটি কমিশনারদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছে। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল যেভাবে সেনা নিয়োগ চাইছে, তা বিদ্যমান আইনে সম্ভব নয়। আর এ আইন সংশোধনের এখতিয়ার সংসদের হাতে।
এ অবস্থায় বিএনপির দাবির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের অবস্থান বিপরীতমুখী হলেও অনেকের ধারণা, এখনো সময় আছে। ক্ষমতার বাইরের দলগুলোর দাবির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের অবস্থানও পাল্টে যেতে পারে। দেশবাসীর কাঙ্ক্ষিত একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ অসম্ভব কিছু নয় বলে অনেকে মনে করেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপির জনসভার মাধ্যমে রাজনীতিতে গুমোট পরিবেশ কিছুটা দূর হয়ে সুবাতাস এসছে। তবে এ সমাবেশকে কেন্দ্র করে নেতিবাচক যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি রোধ হওয়া দরকার। জানালা খুলে দিয়ে আবার বন্ধের চেষ্টা করা উচিত নয়। মানুষ সবার কাছে সহনশীলতা ও অ্যাকোমোডেশন আশা করে।
বিএনপির দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, এসব দাবি রাজনৈতিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাবিও পরিবর্তন হয়। রাজনৈতিক এসব দাবির মাধ্যমে দলের কর্মকাণ্ড বাড়বে। এগুলো রাজনৈতিক কৌশল। এ কৌশলে ভবিষ্যতে ইতিবাচক ফলও আসতে পারে, আবার নেতিবাচকও কিছু ঘটতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত রবিবারের জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসন যেসব দাবি জানিয়েছেন, তা নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই দলটির এ ধরনের দাবি আমরা শুনে আসছি। সরকারি দলের অবস্থান এর বিপরীত। দুই দলের এ অবস্থান বজায় থাকলে দেশের পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে যাবে। আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে মনে করি, এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। বিএনপি বহুদিন পর সরকারের বিধিনিষেধ মেনেই জনসভা করেছে—এটা ইতিবাচক। আশা করি, দেশের রাজনীতিতে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা তৈরি হবে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও বিনা বাধায় সমাবেশ করার অধিকার ফিরে পাবে। ’
বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসির দায়িত্ব শুধু নির্বাচন করা নয়; দায়িত্ব হচ্ছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, সরকার যে আইন করে দেবে সে আইন অনুসরণ করেই নির্বাচন হবে—এ বক্তব্য হতাশাজনক। নির্বাচন কমিশনের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। এসব প্রস্তাবের যেগুলো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, সেগুলো বাস্তবায়ন সম্পর্কে সরকারের কাছে দাবি জানাতে হবে। আর যদি নির্বাচন কমিশন মনে করে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই, সে ধরনের পরিবেশ তৈরিতে সহযোগিতা পাচ্ছে না, তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, “বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলোর বর্তমান সরকারব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো অবস্থান নেই। ২০১৪ সালে এক পক্ষের যেকোনোভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান আর অন্য পক্ষের নির্বাচন প্রতিরোধ-প্রতিহত করার লড়াইয়ে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা জয়ী হতে পারেনি। অন্যদিকে শাসক দল সে লড়াইয়ে জিতে তাদের মেয়াদও পূর্ণ করতে চলেছে। এ বাস্তবতায় আগামী নির্বাচন বিদ্যমান ব্যবস্থায় হবে, নাকি নতুন ব্যবস্থা আসবে—সেটিই প্রশ্ন। কিন্তু শাসক দল যদি ‘বিনাযুদ্ধে দেব না সূচ্যগ্র মেদিনি’ অবস্থান নেয়, তাহলে বিএনপির দাবি বাস্তবায়ন হওয়া অসম্ভব। দেশে ফেরার পর খালেদা জিয়ার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ করতে যাওয়ার পথে দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক সমাবেশ দলটির কনফিডেন্স কিছুটা বাড়িয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত রবিবার তারা সমাবেশ করেছে। এসব কর্মসূচিতে দলটি অনেকটাই আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে, নেতাকর্মীরা উৎসাহ বোধ করছে। এর ফলাফল হিসেবে দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে বলে আমরা আশা করছি। ”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রবিবারে বিএনপির সমাবেশের ঘটনা নিয়ে আমার প্রশ্ন জেগেছে। তা হচ্ছে, রাজনীতি জনকল্যাণমুখী কি না? রাজনৈতিক সমাবেশ হলেই জনদুর্ভোগ কেন বাড়বে? ১৯ মাস পর বিএনপি জনসমাবেশ করতে পারল। আমাদের জানার ইচ্ছা ছিল, ওই সমাবেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দিকনির্দেশনা আসে কি না। এ সমাবেশের বিষয়টি জনকল্যাণমুখী না হয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বলে মনে হয়েছে। বেগম জিয়া নতুন কোনো কথা বলেননি। নির্বাচন কমিশনে বিএনপি যেসব কথা বলে এসেছে, এ সমাবেশেও তাই বলা হয়েছে। তিনি শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করার, আমলাদের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার কথা বলেছেন। এসবে কিছু যায়-আসে না। তাঁদের নিজেদের দাবি বাস্তবায়নে আন্দোলন গড়ে তোলার সেই শক্তি আছে বলেও মনে হয় না। তবে মাঠ গরম করার জন্য এসব বক্তব্য হতে পারে। আমার মনে হয়, নির্বাচনে আসা ছাড়া বিএনপির অন্য কোনো পথ নেই। ’
আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘একটি বিষয়ে আমার বিপন্ন বিস্ময়। তা হলো কোনো দলই এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলছে না। আর আমি মনে করি, পরিস্থিতির উন্নয়নে নির্বাচন কমিশনকেই ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন বিষয়ে সরকারের সমঝোতা করানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বিএনপির এই সমাবেশ এবং অন্যান্য ঘটনায় এমন কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে আমার মনে হয় না। সংসদ নির্বাচনের এখনো এক বছর বাকি আছে। এখন এ বিষয়ে মন্তব্য করা চর্বিত চর্বন ছাড়া আর কিছুই হবে না। কী হতে চলেছে, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার বিএনপিকে জনসভা করতে দিয়েছে, এটা ইতিবাচক। তবে এর জন্য ২৩টি শর্ত বেঁধে দেওয়া, যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া—এগুলো নিয়ে প্রশ্ন আছে। যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টির ভুক্তভোগী আমি নিজেও। এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য হাস্যকর। এ ধরনের বক্তব্য ও ঘটনা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। ’
এম হাফিজউদ্দিন বলেন, তবে ইতিবাচক পরিবেশের যে সূচনা হয়েছে তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি না, নির্বাচন কমিশন কী করবে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে কি না, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।