জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বিনা মূল্যের যে পাঠ্য বই প্রণয়ন ও মুদ্রণ করে, তাতে পদে পদে অনিয়ম হয়। পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে বিভিন্ন কমিটি গঠন, কর্মশালার আয়োজন, লেখকদলে সদস্য নিয়োগ, বিষয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, প্রুফ রিডার নিয়োগ, সম্পাদনা, লেখা পরিবর্তনসহ নানা ব্যাপারে অনিয়ম হয়।
পাঠ্য বই মুদ্রণে অনিয়মের চিত্র আরো ভয়াবহ। একই কাজে বেতনের পাশাপাশি বছরে ছয়টি বোনাসের পরও আলাদা সম্মানী নেন এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কোনো কোনো কর্মকর্তা বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানেরও মালিক। বিএসটিআইয়ের সনদবিহীন কাগজ ও নিম্নমানের কালি ব্যবহার করে বই ছাপা হলেও সন্তোষজনক প্রতিবেদন দেয় এনসিটিবি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে এনসিটিবির এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে ‘এনসিটিবি : পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশনা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। গবেষণা পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন টিআইবির ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার মোরশেদা আক্তার। ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গবেষণার তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ শেষে প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়।
গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এনসিটিবির কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান, যার প্রতিফলন বিভিন্ন কমিটি গঠন থেকে শুরু করে পাঠ্য বইয়ে লেখা নির্বাচনের মতো বিষয় পর্যন্ত বিস্তৃত।
এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, যথাযথ নয় এবং দলীয় রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রভাব বিদ্যমান। পাঠ্য বই লেখার মতো ‘বিশেষায়িত’ বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না; অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার বাস্তবায়নকারী সংস্থা এনসিটিবি কর্তৃক সম্প্রতি একটি বিশেষ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন ও সংশোধন আনা হয়েছে; যার অনেক কিছুই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও মৌলিক চেতনার পরিপন্থী। এতে মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনে বিচ্যুতি ঘটছে। দীর্ঘদিনেও এনসিটিবি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি জারি না হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে এনসিটিবিকে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে এনসিটিবিকে একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে পুনর্গঠনের দাবি জানান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঠ্য বইয়ের দরপত্র আহ্বানের আগে প্রাক্কলিত দর অন্য কারো জানার কথা নয়। কিন্তু দরপত্র কমিটির একাংশ পছন্দের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে আগেই দর জানিয়ে দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়। এ ছাড়া মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমেও দরপত্র দাখিল করে। এনসিটিবির কোনো কোনো কর্মকর্তা বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানেরও মালিক। একই ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠানকেও কাজ দেওয়া হয়। নিয়মবহির্ভূত অর্থের বিনিময়ে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়। টেকনিক্যাল কমিটির দ্বারা অযোগ্য ঘোষিত হলেও তাদের কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
গবেষণায় বলা হয়, দাপ্তরিক বা সরকারি আদেশ না থাকা সত্ত্বেও পাঠ্যপুস্তক উৎপাদন ও বিতরণ সংক্রান্ত বিভিন্ন নিয়মিত কাজেও এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানী নেন। এ খাতে ২০১৭ সালে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা এবং ২০১৬ সালে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সর্বশেষ মহাহিসাব নিরীক্ষকের (সিএজি) নিরীক্ষায় এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করা হলেও এখনো তা নিষ্পত্তি হয়নি।
জানা যায়, এনসিটিবির কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাঁদের প্রেষণে এখানে পদায়ন করা হয়। তাঁরা একই কাজ করলেও নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি বছরে ছয়টি বোনাস পান। এর পরও বিভিন্ন কাজে সম্মানী নেন।
পাঠ্য বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বলা হয়, ১৯৭৩ সালের মুদ্রণ আইন অনুযায়ী যাঁরা কাজ পাবেন তাঁদেরই তা করার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুদ্রণ, বাঁধাই ও লেমিনেশনের ক্ষেত্রে সাবকন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বিএসটিআইয়ের সনদবিহীন মিলগুলোর কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে কাগজ কেনে। একাধিক কাগজ মিল মানসম্মত কাগজ সরবরাহ করতে না পারার অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হলেও পরবর্তী বছরেও তাদের কাছ থেকে কাগজ কেনা হয়। পর্যাপ্ত কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতার ঘাটতি, সময়মতো কাগজ সরবরাহ করতে না পারা, চুক্তিবদ্ধ মাপ অনুযায়ী কাগজ সরবরাহ না করলেও তাদের কাগজে বই ছাপা হচ্ছে। এনসিটিবির কর্মকর্তাদের একাংশের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত তদারকি প্রতিষ্ঠান সার্বক্ষণিক উপস্থিত না থেকেও আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে সন্তোষজনক প্রতিবেদন দেয়। কোনো কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান তদারকির ভয়ে দিনের বেলা ভালো কাগজে বই ছাপে, রাতের বেলা খারাপ কাগজ ব্যবহার করে। এ বইগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়। আর সময়মতো বই সরবরাহ করা না হলেও নিয়োগকৃত পরিদর্শন ও তদারকি প্রতিষ্ঠান পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের প্রতিবেদনে সঠিক সময়ে বই পৌঁছেছে বলে প্রতিবেদন দেয়।
পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এনসিসিসি, টেকনিক্যাল কমিটি, ভেটিং কমিটি, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কমিটি, লেখক কমিটি গঠনের সময় যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা বা কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এক বিষয়ের বিশেষজ্ঞকে অন্য বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পদায়ন দেওয়া হয়।
গবেষণায় বলা হয়, পাঠ্য বইয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শিক ধারার ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ভাষা ব্যবহারের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বর্তমান জোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগের সময়ে পাঠ্য বইয়ে (সমাজ পাঠ) ‘বাঙ্গালী’ শব্দ ব্যবহার করা হতো না, বরং ‘এদেশের মানুষ’ লেখা হতো। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান বইগুলোতে ‘বাঙ্গালী’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
পাঠ্য বইয়ে পরিবর্তনের বিষয়ে বলা হয়, সম্প্রতি একটি সাম্প্রদায়িক মতাদর্শী গোষ্ঠীর দাবি ছিল মাদরাসার পাঠ্য বইয়ে ‘হিন্দু, খ্রিস্টান বা বিদেশি বলে মনে হয়’ এমন নামের পরিবর্তে ‘সুন্দর ইসলামি নাম’ ব্যবহার করা হোক। ইতিমধ্যে পাঠ্য বই থেকে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে যেকোনো ধরনের সংলাপও প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের চারটি পাঠ্য বই থেকে ১১টি ‘অনৈসলামিক’ কবিতা, বিভিন্ন হিন্দু নাম ও কাহিনী এবং মেয়েদের শারীরিক উন্নতির অধ্যায় থেকে ‘মাসিক’ শব্দ বাদ দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঁচটি পাঠ্য বই থেকে ১৬টি লেখা বাদ দেওয়া হয়, যার মধ্যে উল্লিখিত গোষ্ঠীর দাবি অনুযায়ী ১১টি কবিতাই বাদ দেওয়া হয়েছে। মাদরাসার ইংরেজি পাঠ্য বই থেকে হিন্দু, খ্রিস্টান বা বিদেশি বলে মনে হওয়া সব ধরনের নাম বাদ দিয়ে সেখানে ‘ইসলামি’ নাম দেওয়া হয়েছে। এমনকি সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এনসিটিবির চেয়ারম্যানের নাম মাদরাসার বইগুলোতে উহ্য রাখা হয়েছে।
সম্পাদনার বিষয়ে বলা হয়, সম্পাদনার দায়িত্বপ্রাপ্ত দল দায়িত্ব পালন না করে অফিস সময়ে ইন্টারনেটে শেয়ার ব্যবসা, বক্তিগত আলাপ, ব্যক্তিগত এনজিও ব্যবসা ও মুদ্রণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে ৫৮টি ভুল শোধরানো হলেও ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে আবার ২০টি ভুল দেখা যায়। স্বজনপ্রীতি ও তদবিরের মাধ্যমে দক্ষতাসম্পন্ন নয়, এমন সদস্যকে প্রুফ রিডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাঠপর্যায়ের তথ্য ব্যবহার করে পাঠ্যপুস্তকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনও করা হয় না। কারিকুলাম অনুসরণ না করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে লেখা পরিবর্তন করা হয়। লেখকদের অজ্ঞাতে পাঠ্য বইয়ে লেখা সংযোজন-বিয়োজন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেখা পরিবর্তনে সম্পাদকদের বাধ্য করা হয়। ২০১৩ শিক্ষাবর্ষে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্য বইয়ে শিক্ষা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার কবিতা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
টিআইবি তাদের গবেষণায় ১৫টি সুপারিশ করে। আইন ও নীতি সংস্কারবিষয়ক সুপারিশে বলা হয়, এনসিটিবিকে স্বাধীন কমিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা পাঠ্য বই রচনা, সংকলন, সম্পাদনা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নীতি প্রণয়নে কাজ করবে। কমিশন গঠনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে, যারা তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে এই কমিশন গঠনের বিষয়ে সুপারিশ করবে। এই কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত এনসিটিবির কার্যক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব হ্রাস করতে হবে, সিলেবাস ও টেক্সট বুক কমিটির সদস্যদের যোগ্যতা ও মেয়াদ নির্ধারণ করতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাসংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়েছে, বর্তমান পাঠ্যক্রম প্রকাশ উন্মুক্ত করতে হবে ও নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। শিক্ষাবিষয়ক ও শিক্ষাক্রমের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এনসিটিবির বোর্ডে (বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য) সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। সব তদন্ত প্রতিবেদন (প্রণয়ন ও প্রকাশনাসহ) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশনার প্রত্যেক ধাপ যথাযথভাবে নথিভুক্ত করতে হবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য ই-টেন্ডারিং প্রচলন করতে হবে। মুদ্রণ তদারকির সঙ্গে জড়িত এনসিটিবির কর্মকর্তাদের কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে হবে।
গবেষণা প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
সুত্রঃ কালেরকন্ঠ