মাত্র দুই বছর আগের কথা। জান্তা শাসন থেকে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় বিশ্ব উল্লসিত হয়েছিল। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ভূমিধস জয় পায়।
নিঃসন্দেহে এনএলডির এই জয় ছিল ঐতিহাসিক, অভূতপূর্ব। আরও বিস্ময়কর ছিল, যে জেনারেলরা এনএলডি নেত্রী অং সান সু চিকে প্রায় দুই দশক বন্দী করে রেখেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকেই ক্ষমতা নেন তিনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব দৃশ্যে প্রত্যাশার বেলুন ফুলে উঠেছিল। কিন্তু এখন মিয়ানমারে যা হচ্ছে, তা বেদনাদায়ক। মিয়ানমার নিয়ে আশা ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছে।
অহিংস গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সু চি নিজেকে বিশ্বমঞ্চে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী হিসেবে বিশ্ববাসী যে সু চিকে দেখছে, তাঁকে চিনতে বড্ড কষ্ট হয়। তিনি তাঁর সংগ্রামী, অনমনীয়, আপসহীন ভাবমূর্তি ধরে রাখতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছেন। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হচ্ছে।
শান্তি, সম্প্রীতি, গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পেয়েছিলেন সু চি। অথচ এখন তাঁর শাসনামলে মিয়ানমারে চলছে চরম বর্বরতা। জাতিগত নিধনযজ্ঞের মুখে গত প্রায় দুই মাসে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই নির্মমতার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। তারা লোমহর্ষক সব কাহিনি শোনাচ্ছে। এমনকি এখনো রাখাইনে গ্রাম জ্বলতে দেখা যায়।
রাখাইনের পরিস্থিতি পুরো জানা কঠিন। কারণ, সেখানে বাইরের মানুষের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তবে রাখাইন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা মানতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটা অন্যতম বৃহত্তম শরণার্থী সংকট। একই সঙ্গে এটি অন্যতম বৃহত্তম জাতিগত নিধনযজ্ঞও।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে অনেক সাধারণীকরণ লক্ষ করা যায়। অনেকে রোহিঙ্গাদের বর্তমান দুর্দশার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে দোষারোপ করছে। গোষ্ঠীটিই গত আগস্টের শেষ দিকে রাখাইনে সেনা ও পুলিশ তল্লাশিকেন্দ্র হামলা চালিয়েছিল। তাদের হামলার জেরে রাখাইনের নতুন করে ‘দমন অভিযান’ শুরু হয়। এই দফার দমন অভিযানে সর্বাধিকসংখ্যক রোহিঙ্গা রাখাইন ছাড়ে। কিন্তু এ কথা তো সত্য যে আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির সদস্যসংখ্যা খুবই কম। আর তারা খুব একটা প্রশিক্ষিতও নয়। দশকের পর দশক ধরে চলমান দমন-পীড়নই তাদের এই পথে এনেছে।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সংকটকে জটিল করে তুলেছে। রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক মানতে নারাজ মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের তারা ‘বাঙালি’ নামে সম্বোধন করে। রোহিঙ্গাদের জন্মহার নিয়েও মিয়ানমার শঙ্কিত।
মিয়ানমারের সুশীল সমাজ অনেক বিষয়ে প্রগতিশীল কথাবার্তা বলে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা তাদের চোখ-কান বন্ধ করে রাখে। মনের দরজায় দেয় তালা।
সবচেয়ে হতাশার দিকটি হলো, এত আলোচনা-সমালোচনার পরও রোহিঙ্গাদের ওপর হামলাকারী সেনা, পুলিশ বা উগ্র বৌদ্ধদের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন সু চি। রাখাইনে রোহিঙ্গারা নির্বিচারে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার হলেও সু চি কৌশলী বক্তব্য দিয়ে দায় সারছেন। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তাঁর সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সু চির আমলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু এখন অবস্থাদৃষ্টে মন হয়, এই আশা দুরাশা। সরকার পরিচালনায় সু চি খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন বলে মনে হয় না। সু চির নামে সরকার চলছে। কিন্তু খেলা খেলছে অন্য কোনো পক্ষ।
রোহিঙ্গা সংকটের পরিপ্রেক্ষিত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে পশ্চিমারা ভাবনাচিন্তা করছে। তাদের ভাবনায় দেশটির সেনাবাহিনী ও রাজনীতির মধ্যকার জটিল সমীকরণটি গুরুত্ব পাচ্ছে।
মিয়ানমারের ওপর আগেও অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল। রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশটির ওপর নতুন অবরোধ কতটা কাজ দেবে, তা নিয়ে অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। যুক্তরাষ্ট্র তো বলেই দিয়েছে, তারা শাস্তির বদলে কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যার সমাধান চায়। কিন্তু কীভাবে সেই সমাধান আসবে, তার কোনো সুস্পষ্ট কর্মপন্থা দেখা যাচ্ছে না।
যে যা-ই বলুক না কেন, বাস্তবতা হলো—মিয়ানমারের ক্ষমতার কেন্দ্রে দেশটির সেনাবাহিনীর অবস্থান এখনো বেশ শক্তপোক্ত। সু চিকে নিয়ে সবার মধ্যে হতাশা আছে। কিন্তু এটা তো সত্য, তিনি মিয়ানমারের মূল খেলোয়াড় নন। সু চি সরকারে আছেন বলে তাঁকে দু-চার কথা বলা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি সরে গেলে মিয়ানমার পুরোনো পথেই হাঁটবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাতে দেশটির শান্তি ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তাই মিয়ানমারের বিষয়ে বিশ্বকে ভেবেচিন্তেই এগোতে হবে।