বৃদ্ধ বয়সে ভাতা নেওয়ার যন্ত্রণা

Slider খুলনা

051757532f2d4eda0db59799f74ce506-norail

 

 

 

 

অশীতিপর বৃদ্ধ অন্ধ খায়রুন্নেছা (৮১) অবসর ভাতা নিতে এসেছেন ব্যাংকে। সেখানে বসার জায়গা নেই। শত শত মানুষের ভিড়ে গরমে যেন নাভিশ্বাস উঠছে তাঁর। প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। মাঝেমধ্যে শরীরের ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছেন। কখন পেনশন নেওয়ার ডাক পড়ে—এই ভয়ে দুপুরে খেতে যেতে পারেননি। এ অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। ১২ বছর বয়সী নাতি সুরাইয়া তাঁকে নিয়ে এসেছে পেনশন তুলতে। হাসপাতালে চাকরি করতেন তিনি।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকের লক্ষ্মীপাশা শাখায় খায়রুন্নেছার সঙ্গে কথা হয় ৩ অক্টোবর বিকেল চারটায়। তখনো পেনশন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তিনি জানান, তাঁর বাড়ি ইতনা ইউনিয়নের ডিগ্রিরচর গ্রামে। এখান থেকে দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। সকাল আটটায় এসেছেন হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে। সেখান থেকে ব্যাংকে এসেছেন বেলা ১১টায়। তিনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন, ‘জানটা (প্রাণ) মনে হচ্ছে হ্যান্নেই বারোয় যাবে।’

শুধু খায়রুন্নেছাই নন; এই ব্যাংকের ভেতরে, সিঁড়িতে ও সামনে দাঁড়িয়ে বা বসে পেনশন নিতে কয়েক শ প্রবীণ অপেক্ষা করছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছেন প্রবীণ নারী-পুরুষেরা। ভিড় ঠেলে কান লাগিয়ে শুনছেন পেনশন নিতে তাঁর ডাক পড়ে কি না। যেকোনো মুহূর্তে ডাক পড়তে পারে—এই উদ্বেগও আছে। পাঁচুড়িয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল হোসেন (৭৬), ইতনা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য সোনা মিয়া (৭৮) ও লাহুড়িয়া গ্রামের সিরিয়া বেগম (৬৭) জানালেন, সকাল আটটায় হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে তাঁরা এসেছেন, বিকেল চারটায়ও পেনশন পাননি। শারীরিক দুর্বলতায় পেনশনভোগীরা এভাবে অপেক্ষায় থাকতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

এর আগে বেলা ১১টায় হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, এই কার্যালয়ের চারটি কক্ষ, বারান্দা ও কার্যালয়ের সামনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সবাই ভিড় ঠেলে চেষ্টা করছেন নিজের পেনশন বইটি নিবন্ধন খাতায় অন্তর্ভুক্ত করাতে। আবার ভিড়ে পেনশন বই হারিয়ে যায় কি না, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন তাঁরা। এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে নিজ নিজ এলাকার ব্যাংক থেকে সরাসরি পেনশন তোলার ব্যবস্থা করার দাবি জানান তাঁরা।

উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলায় পেনশনভোগীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। তাঁদের প্রতি মাসে হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে পেনশন বই নিবন্ধন করে সোনালী ব্যাংক লক্ষ্মীপাশা শাখা (ট্রেজারি শাখা) থেকে টাকা তুলতে হয়।

এই শাখার ব্যবস্থাপক মো. আবুল কালাম বলেন, মাসের প্রথম সপ্তাহে পেনশনভোগীরা আসেন টাকা তুলতে। এ সময় গড়ে প্রতিদিন ৫০০ পেনশনভোগীর ভিড় সামাল দিতে হয়। ব্যাংকে কর্মী আছেন ১৩ জন। দরকার অন্তত ২৫ জন। ক্যাশ অফিসার আছেন ৩ জন, দরকার কমপক্ষে ৫ জন। নড়াইল জেলার মধ্যে এই ব্যাংকের এই শাখায় আমানত, ঋণ ও মুনাফা বেশি, অথচ তুলনামূলক জনবল কম। পেনশন ছাড়াও এই শাখা থেকে সরকারি বেতন, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, দলিত-হরিজন-বেদে ভাতা, বিভিন্ন প্রকল্পের বিল দেওয়াসহ নানা লেনদেন করতে হয়। তাই ব্যাংকের কর্মীদের হয় গলদঘর্ম অবস্থা। পেনশনভোগীদেরও পোহাতে হয় দুর্ভোগ।

উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা স্বপন কুমার বিশ্বাস জানালেন, পেনশনভোগীদের দুর্ভোগ লাঘব করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সাত-আট বছর আগে থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর পেনশন প্রদানের দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়। লোহাগড়ায়ও এ রকম দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। কিন্তু কোনো ব্যাংক সেই দায়িত্ব নেয়নি। এটা বাস্তবায়িত হলে হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে পেনশনভোগীদের আসতে হতো না। দেশের অধিকাংশ উপজেলায় এ পদ্ধতি থাকলেও লোহাগড়ায় তা চালু হয়নি।

এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংক লোহাগড়া বাজার শাখার ব্যবস্থাপক মো. আবু সেলিম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *