আপন গৃহের সামনে লাশ হয়ে পড়ে ছিলেন ভারতীয় সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। বছর পঞ্চান্নের এই নারীর রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। একজন প্রভাবশালী নারী, একজন সাংবাদিক-লেখক, যাঁর পিতা পি. লঙ্কেশ ছিলেন প্রখ্যাত কবি-লেখক, যাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। গৌরীকে মোটরবাইকে আসা আততায়ীরা গুলি করতে পারে খুব কাছ থেকে।
গৌরী হত্যার মূলে উগ্রপন্থীরা। গৌরী এমন এক দেশের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে ‘হিন্দু-যবন বিচার নেই, এক চাঁদে হয় জগৎ আলো’। ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর তীব্র বিরোধী ছিলেন তিনি। নিজের মতপ্রকাশে দ্বিধা করেননি। কর্ণাটকের হিন্দুত্ববাদীরা মৃত্যুপরোয়ানা দিয়ে রেখেছিল। তারা কথা রেখেছে। শহীদ হয়েছেন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ।
গৌরীকে হত্যা করেছে উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।
এ ঘটনায় আরেক ধরনের রাজনীতির দেখা মেলে। সারা ভারতেই কমবেশি প্রতিবাদের ঢল নামে। প্রতিবাদে শামিল হন আমাদের প্রতিবেশী ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মানিকের রাজ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আরেকজন তরুণ সাংবাদিক শান্তনু ভৌমিককে। ‘দিনরাত’ টেলিভিশনের প্রতিবেদক, একজন তরুণ। ‘তুইপ্রাল্যান্ড’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রভূমি চায় স্থানীয় আদিবাসীরা। এদের ঠেকাতে মাঠে ক্ষমতাসীন বামপন্থী সমর্থক আদিবাসীরাও। একদিন মুখোমুখি তারা। নিয়মিত ক্যামেরাম্যান ভয়ে স্পটে আসছেন না দেখে মোবাইলেই শুট করতে নেমে যান ছেলেটি। সতর্ক করা হয়, সরে যেতে বলা হয়। জীবনের মায়া করেননি শান্তনু। যারা পিটিয়ে মেরেছিল, তারা মানিক সরকারের পক্ষেরই লোক। এবার মানিকবাবু চুপ। মুখে কোনো রা নেই।
মানিক সরকার সাদাসিধে রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু রাজনীতির কাছে গোল খেয়ে যায় বিবেক। সামান্য প্রতিবাদটুকু করার সাহস দেখাতে পারেননি তিনি।
শান্তনু ভৌমিককে হত্যা করেছে ক্ষমতার রাজনীতি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতেন কারুয়ানা গালিজিয়া। পানামা পেপারসে যাদের নাম এসেছে, তাদের দুর্নীতির প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছিলেন তিনি। আর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে লিখতেন নিজের ব্লগে। মনে করতেন, এটাই তাঁর কাজ, এটাই তাঁর দায়িত্ব। প্রকৃত সাংবাদিককে কেউ অর্থের বিনিময়ে কিনতে পারে না। সত্যিকারের সাংবাদিক কোনো অপরাধীর সঙ্গে আঁতাত করতে পারেন না। কারুয়ানাকে কেউ কিনতে পারেনি। কারুয়ানা কারও সঙ্গে আঁতাত করেননি। অতি সম্প্রতি ইউরোপের দেশ মাল্টার রাজধানী শহরে নিজের বাড়ির সামনে হঠাৎ গাড়িবোমায় ছিন্নভিন্ন হয় কারুয়ানার রক্ত-মাংস।
কারুয়ানা গালিজিয়াকে হত্যা করেছে দুর্নীতিবাজ অপরাধীচক্র।
নির্মম হলেও সত্য, সত্যিকারের সাংবাদিকের জন্য কোনো নিরাপদ আবাস নেই। সবখানেই তাঁরা অরক্ষিত।
বিবিসির মতে, ভারতে যেসব সাংবাদিক হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সমালোচনায় মুখর ছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন নিয়মিত। নারী সাংবাদিকদের অনবরত দেওয়া হচ্ছে ধর্ষণের হুমকি। দেশটিতে ১৯৯২ সালের পর ৪১ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট বা সিপিজে বলছে, বিগত বছরে বিশ্বব্যাপী নিহত হয়েছেন ২৫ জন সাংবাদিক, আর কারাগারে আছেন ২৫৯ জন। নিখোঁজ আছেন ৫৫ জন। সাংবাদিকতা কোনো ‘কৌতুক’ নয়, এটা একটা কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। যেখানে একজন প্রতিবেদককে একটা ‘স্কুপ’ খুঁজতে হয় ধৈর্য আর কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা নিয়ে। তাই কখনো তাঁদের হত্যা করা হয়, কখনো তাঁদের জেলে পোরা হয়, কখনো গুম করে দেওয়া হয়।
হাতে আছে কাঠমান্ডু পোস্টে প্রকাশিত মীরা রাজভান্ডারি অমাত্যর একটি লেখা। নেপালি সাংবাদিকদের ফেডারেশন এফএনজির সদস্য মীরার লেখায় বর্ণিত হয়েছে দেশটির গণমাধ্যমের বর্তমান চালচিত্র। নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্র ফেরার পর গণমাধ্যম ব্যবসায় যে সুবাতাস বইছিল, তা একেবারে থেমে যায় সশস্ত্র মাওবাদী লড়াই ও রাজা জ্ঞানেন্দ্রর প্রত্যক্ষ শাসনামলে। ১৯৯৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে নিহত হন ৩৪ জন সাংবাদিক। নেপালের সংবিধানে মতপ্রকাশের অধিকার, তথ্য অধিকার সবই আছে। তবে কাজির গরু কেবল কেতাবেই আছে, গোয়ালে নেই। মানে অধিকারের বাস্তবায়ন নেই। ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপব্যবহারের অভিযোগ। এফএনজি বলছে, গত বছরের মে থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এ রকম ৬৭টি অভিযোগ খাড়া করা হয়েছে। দুর্নীতি, অপরাধ নিয়ে লিখলেই কোনো না কোনো ছুতোয় এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে, যা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে রুদ্ধ করা হচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতা।
বাংলাদেশে কি সাংবাদিকতামুক্ত পরিবেশে বিকশিত হচ্ছে? কদিন আগেও দেখেছি গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর ৫৭ ধারার খড়্গ।
সিপিজে গবেষণা করে দেখিয়েছে, রাজনীতি, যুদ্ধ, অপরাধ, দুর্নীতি—এই বিষয়গুলো নিয়ে যেসব সাংবাদিক প্রতিবেদন করেন, তাঁরা বেশি হামলার ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অন্যান্য বিটে এই ঝুঁকি তুলনামূলক কম।
তাহলে উপায় কী? রাজনীতি, অপরাধ, দুর্নীতি নিয়ে কি লেখা যাবে না?
কোনো সাংবাদিকের যদি ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির বিষয় থাকে, সে জন্য তো আইনের শিকল রইলই। তাই বলে সাংবাদিকতার গলায় ফাঁস কেন?
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর মুক্ত সাংবাদিকতা স্বচ্ছ উন্নয়ন ও মুক্ত সমাজের মেরুদণ্ড। সমাজ-রাষ্ট্র-ব্যক্তি মানুষের উন্নয়ন চাইলে সাংবাদিকতাকে মুক্ত করতে হবেই।
দেশে দেশে, কালে কালে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এই উপলব্ধি কি আদৌ হবে?