২০ অক্টোবর শুক্রবার পত্রিকার অনেক খবরের একটি হচ্ছে রাজধানীর বনানীতে আলোচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণ মামলার আসামিরা বাদীকে মীমাংসা করে ফেলার জন্য হুমকি দেওয়ার ঘটনা। এ ছাড়া অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে এবং খুদে বার্তা দিয়েও তাঁকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে বলে খবরে জানানো হয়েছে। না, খবরটি পড়ে একটুও অবাক হইনি। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল, তা-ই না? বরং এটা ভেবে বিস্মিত হয়েছি যে আসামিরা এত দেরি করল কেন হুমকি দিতে? এটা আরও বহু আগেই করার কথা তাদের।
সাধারণত গ্রামে-গঞ্জে বা মফস্বল শহরে দেখা যায়, ধর্ষণ মামলার আসামিরা একটু প্রভাবশালী হলেই বাদীকে মামলা তুলে নিতে হুমকি-ধমকি দেয়। আর বনানীর দুই ছাত্রী ধর্ষণের মামলার আসামিরা তো বিরাট প্রভাবশালী। তাদের অর্থের কোনো অভাব নেই। হাতে থাকা ‘ক্ষমতা’ তারা তো ব্যবহার করে রেহাই পেতে চাইবেই।
খুব ভয় পাচ্ছি, এই ধর্ষণ মামলার আসামিরা হয়তো প্রভাব খাঁটিয়ে ঠিকই পার পেয়ে যাবে। খবরে অন্তত সে রকম গন্ধই পাওয়া যাচ্ছে। আসামিরা এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে মামলাটি ছিল মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে সেদিন কোনো ধর্ষণের ঘটনাই ঘটেনি!
এভাবে যদি বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে, তবে তা হবে খুবই দুঃখজনক। ধর্ষণের ঘটনা ঘটার এক মাস সাত দিন পর ওই দুই ছাত্রীর একজন বনানী থানায় মামলা দায়ের করেন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, থানা প্রথমে তাঁর মামলা নিতে চায়নি। নানা অজুহাত তুলে গড়িমসি করছিল। যা হোক, মামলা নিলেও আসামিদের গ্রেপ্তারে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, নানা অজুহাতে আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখ ও সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ কেবলই পিছিয়েছে। যা হোক, গত ১৩ জুলাই মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৬ অক্টোবর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ওই দিন মামলার বাদী সাক্ষ্য দেন। খবর অনুযায়ী, বাদী আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো আসামিদের হুমকি-ধমকির কারণেই এই ভয়। হয়তো কেন বলছি! নিশ্চিতভাবেই হুমকি-ধমকির কারণেই এই ভয়। আসামিপক্ষের আইনজীবী ওই দিন তাঁকে আংশিক জেরা করেছেন। ৩১ অক্টোবর জেরা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আমি নিশ্চিত, এই ৩১ তারিখ পর্যন্ত বাদীকে আরও হুমকি দেওয়া হবে। আর এভাবে অব্যাহত হুমকি-ধমকির ফলে একসময় বাদী তাঁর মনোবল হারিয়ে ফেলবেন। ব্যস, মামলা ডিসমিস।
আমাদের দেশে এ রকমটাই হয়ে আসছে। হুমকি-ধমকিতে ভয় পেয়ে ধর্ষণের শিকার নারী ধর্ষকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন—এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। আসলে আমাদের দেশে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে না। আইন চলে প্রভাবশালীদের ইচ্ছেমতো। তাদের ক্ষমতা ও অর্থের কাছে আইনও কখনো-সখনো নতিস্বীকার করে। ফলে ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পায় না। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে।
শুক্রবার ছাপা হওয়া ওই খবরের নিচে অনলাইনে এক পাঠকের মন্তব্য হচ্ছে, ‘আদালত ও আইনের শাসন যেহেতু এ দেশে নেই, তাই সুবিচার আশা করাটাও অন্যায়। আওয়ামী লীগের অনেক হোমরাচোমরাই ওদের থেকে মাসোহারা পায়, তাই তদন্ত পর্যায়েই যে গোঁজামিল শুরু হবে, তা বোঝাই গেছে প্রথম থেকে।’
আরেক পাঠক মন্তব্য করেছেন, ‘টাকা নিয়ে মামলা তুলে ফেলেন, এমনিতেও তাদের কিছুই হবে না। যদি পারেন নিজের বিচার নিজেই করেন।’
এই দুই পাঠকের মন্তব্য পড়ে বোঝা যাচ্ছে, স্পষ্টতই দেশের আইনের ওপর তাঁদের আস্থা নেই এবং তাঁরাও ভয় পাচ্ছেন, এই ধর্ষণ মামলার আসামিদের কোনো সাজা হবে না। উল্টো ফেঁসে যেতে পারেন ধর্ষণের শিকার এই নারীরা।
কিন্তু এ রকম তো চলতে পারে না। কত দিন আমরা প্রভাশালীদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির কাছে নতি স্বীকার করব? ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করেও তারা পার পেয়ে যাবে? এটা তো হতে দেওয়া যায় না। গ্রেপ্তারের পরপরই এই ধর্ষণ মামলার আসামিরা পুলিশের কাছে স্বীকার করছিল যে তারা ধর্ষণ করেছে এবং তারা এটাকে অপরাধ বলে মনে করে না। আনন্দ-ফুর্তি বলেই মনে করে। আমরা আশা করব, আদালত তাদের বিচারের সময় এসব কথা মনে রাখবেন। অর্থ, প্রতিপত্তি বা কোনো ভয়ভীতির কাছে আদালত নতি স্বীকার করবেন না। এই ধর্ষকদের কঠোর সাজা দিতেই হবে। কোনোভাবেই যেন তারা পার না পায়।