ভাগ্য বদলের আশায় স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে ঢাকায় আসেন রিকশাচালক আজিজুল হক (৪০)। গত ২৪ মার্চ রাতে কম খরচে গ্রামের বাড়ি যেতে একটি সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে ওঠে পুরো পরিবার। পথে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকায় ট্রাকটি উল্টে যায়। পরদিন সিমেন্টের বস্তার স্তূপ থেকে বের করা হয় আজিজুল, তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলেসহ ১০ জনের লাশ।
শুধু আজিজুল ও তাঁর পরিবার নয়, মহাসড়কে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে তাজা প্রাণ। দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির বিষয়ে সাংবাদিকদের পাঠানো তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২২৮ দিনে মোট ১ হাজার ৪৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছেন ২ হাজার ১১১ জন। গড়ে দিনে মারা যান প্রায় ১০ জন। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ৫১ দশমিক ৬৩ শতাংশ ঘটেছে মহাসড়কে এবং মারা গেছেন ১ হাজার ৯০ জন। অবশ্য ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলেছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশ ঘটে মহাসড়কে।
জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। এসব মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে পুলিশের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মহাসড়কে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে সেগুলো সমাধানে কাজ করা হচ্ছে।
মহাসড়কের দুর্ঘটনাগুলো জেলাওয়ারি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব জেলার ওপর মহাসড়কের পরিমাণ বেশি, সেসব এলাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেশি। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম জেলায়, যা মোট দুর্ঘটনার ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য জেলাগুলো অভিমুখের সড়কে এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। এসব সড়ক দুর্ঘটনায় ঘুরেফিরে এসেছে মীরসরাই, হাটহাজারী, আনোয়ারা, পটিয়া, ফটিকছড়ি এলাকার নাম।
এরপর সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে ঢাকায় (ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলার মধ্যে থাকা এলাকা ধরে)। যা মোট দুর্ঘটনার ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। রাস্তা পারাপারের সময়, অন্য যানের চাপা বা ধাক্কায়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে।
জেলা হিসেবে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে বগুড়ায়। উত্তরবঙ্গের ১০টি জেলায় যাওয়ার মহাসড়ক বগুড়ার ওপর দিয়ে গেছে।
পরিবহন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হওয়ার আগে কুমিল্লায় প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটত। মহাসড়কটি চার লেন ও সড়ক বিভাজক হওয়ার পর দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেছে। এ জেলার ওপর দিয়ে ১০০ কিলোমিটার মহাসড়ক চলে গেছে। গত ২২৮ দিনে এ জেলায় যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা মোট দুর্ঘটনার মাত্র ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ অংশের সড়কটি আগে দুর্ঘটনাপ্রবণ ছিল। কিন্তু রাস্তার ব্ল্যাক স্পট বা অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা সংস্কারের পর এখন সেখানে দুর্ঘটনার হার অনেক কমে গেছে। এই ২১৮ দিনে এ জেলায় ৮টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মহাসড়কের দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে মূলত একাধিক যানবাহনের মধ্যে মুখোমুখি বা পার্শ্বিক সংঘর্ষ, যানবাহন খাদে পড়ে যাওয়া, নিয়ন্ত্রণ
হারিয়ে উল্টে যাওয়া, ছোট যানবাহনকে বড় যানবাহনের চাপা দেওয়ার কারণে। এর মধ্যে বাস-বাস বা বাস-ট্রাক সংঘর্ষ, অন্য যানকে দ্রুতগতিতে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা বেশি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, দুর্ঘটনার জন্য সড়কের অব্যবস্থাপনা অনেকাংশে দায়ী। আগে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুর্ঘটনা বেশি ঘটত। এখন ছোট গাড়ির সঙ্গে বাস-ট্রাকের দুর্ঘটনা বাড়ছে। স্বল্প গতির অনিবন্ধিত যানবাহন চলাচল বন্ধ করা গেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমবে।
মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ নানা নামে চলা অনিবন্ধিত ছোট যানগুলো অনেক সময় বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়ক মন্ত্রণালয় ও উচ্চ আদালত মহাসড়কে স্বল্প গতির যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও এসব যান চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। মহাসড়কে অনিরাপদ এসব যানবাহন বন্ধ হলে সড়ক দুর্ঘটনা এক-তৃতীয়াংশ কমে যাবে।