ঢাকা: চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময় লন্ডন অবস্থানের পর আজ দেশে ফিরছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। লন্ডন থেকে গতরাতে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। আজ বিকাল ৫টা ২০মিনিটে হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে তার। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীরা বিপুল উপস্থিতির মাধ্যমে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে বিদায় জানান। আজ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির সিনিয়র নেতারা হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দলের চেয়ারপারসনকে স্বাগত জানাবেন। এদিকে চিকিৎসা শেষে লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটি ও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করার কথা থাকলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি দ্রুত দেশে ফিরছেন।
এই জন্য লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটি ও দলের নেতাকর্মীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপি। সম্প্রতি কুমিল্লা ও ঢাকার দুইটি আদালত আলাদা তিন মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এবারই প্রথম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরছেন তিনি। এদিকে দেশে ফিরেই আগামীকাল বৃহস্পতিবার আদালতে যাবেন খালেদা জিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী ও দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আদালত খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল করেছেন। তাই বৃহস্পতিবার চেয়ারপারসন আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিনের পিটিশন দেবেন। ওদিকে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা ও বিমানবন্দরে তাকে বরণ করতে নেতাকর্মীদের গণজমায়েতের প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে সোমবার রাত থেকে নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িতে অভিযান ও ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। বিএনপিসহ অঙ্গদলের শীর্ষ নেতাদের আসামি করে রাজধানীর কয়েকটি থানায় নতুন করে কিছু মামলাও হয়েছে। যুবদল কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান বলেন, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সিনিয়র নেতাদের নামে নতুন করে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। পুলিশ নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। আমার বাসায়ও কয়েক দফায় খোঁজ-খবর নিয়ে গেছে পুলিশ। ফলে নেতাকর্মীরা নিজেদের বাসাবাড়িতে অবস্থান করতে পারছে না। নেত্রীকে বরণ করতে যে প্রস্তুতি সেখানেও ব্যাঘাত ঘটছে। তারপরও নেতাকর্মীরা কৌশলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা এবারের জমায়াত অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হবে। এদিকে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার খবরে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। বিপুল উপস্থিতির মাধ্যমে চেয়ারপারসনকে বরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী মানবঢালের মতো অবস্থান নেবেন। বিএনপি নেতারা জানান, বিমানবন্দরে বিপুল উপস্থিতির মাধ্যমে নেত্রীকে বরণ করতে বড় ধরনের শোডাউনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতারা গত দুইদিন ধরে সে প্রস্তুতি শুরু করেছেন। একইভাবে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, ছাত্রদলসহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ও মহানগরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুতি সভা করা হচ্ছে। চেয়ারপারসনকে বরণ করতে বিপুল নেতাকর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আলাদা আলাদা প্রস্তুতি সভা করেছে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলাদলসহ অঙ্গদলগুলো। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আগমন উপলক্ষে ঢাকার বিমানবন্দরে গণসংবর্ধনা সফল করতে গতকাল এক প্রস্তুতি সভা করেছে রাজধানীর পল্লবী ও রূপনগর থানা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সহ-সভাপতি আলহাজ একেএম মোয়াজ্জেম হোসেনের সভাপতিত্বে প্রস্তুতি সভায় ওই দুই এলাকা থেকে পাঁচ হাজার লোক সমাগম করার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা মহানগর বিএনপির অন্যান্য ইউনিটগুলোও একই ধরনের প্রস্তুতি সভা করেছে। ওদিকে ঢাকার প্রতিবেশী জেলা গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও শোডাউনে অংশ নেবেন। বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, ঢাকার আশপাশের জেলার নেতাকর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইতিমধ্যে ঢাকা চলে এসেছে। আজ দুপুরের মধ্যেই তারা বিমানবন্দর থেকে কুড়িল বিশ্বরোড ও বনানী কবরস্থান হয়ে গুলশান পর্যন্ত এলাকায় কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে অবস্থান নেবেন। বিমানবন্দর থেকে বনানী কবরস্থান রোড পর্যন্ত এলাকার প্রতিটি পয়েন্টে কর্মী-সমর্থকসহ অবস্থান নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপি। ওদিকে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপি। সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এমএ মালিক জানান, মঙ্গলবার রাতে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে এমিরেটসের একটি বিমানে করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। বুধবার বিকালে তিনি বাংলাদেশে পৌঁছবেন। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক ও সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমদ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসা শেষে বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তারা জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জটিল চক্ষু চিকিৎসার কারণে দীর্ঘ সময় লেগেছে। চিকিৎসা শেষে বিশ্রামের পর যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি কমিউনিটি, সাংবাদিক ও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বহু প্রত্যাশিত সৌজন্য সাক্ষাৎ ও সভা করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিটিতে দ্রুত দেশে ফেরার কারণে সময় স্বল্পতার জন্য তা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং দেশে সুস্থভাবে পৌঁছানোর জন্য দোয়াও চেয়েছেন যুক্তরাজ্য বিএনপির মাধ্যমে। যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতারা বলেন, দেশের বাইরে খালেদা জিয়ার কোনো ঠিকানা নেই। তার দেশ ছাড়ার গুজব যারা ছড়িয়েছেন বুধবারে বাংলাদেশে পৌঁছার মাধ্যমে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপসহীন নেত্রী গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পরোয়া করেন না। যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতারা বলেন, বাংলাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীরা ব্যাপকহারে জমায়েত হয়ে বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন। সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এমএ মালিক জানান, বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে আসা নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, হামলা বা ধরপাকড় চালালে ওই দিনই সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। এদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেছেন, চিকিৎসা শেষে আজ খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন। সরকার বলছেন, উনি চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করছেন। উনি আর আসবেন না। আমি বলতে চাই, উনি দেশ, গণতন্ত্র ও জনগণের নেত্রী। আর পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস তো আওয়ামী লীগের নেত্রীর। আপনাদের অপপ্রচার ও মিথ্যাচারকে বিপন্ন করে আজ খালেদা জিয়া তার জনগণের কাছে ফিরে আসছেন। সরকারকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আপনারা ভাবছেন তার মনোবলকে দুর্বল করবেন। এটা ভেবে আপনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এদিকে বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও যুবদল কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান, ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান, সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান, সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুনুর রশীদ মামুন, সহ-সভাপতি সৈয়দ মহিদুল হাসান হিরু, জাকির হোসেন মিন্টুু, দপ্তর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী, পাঠাগার সম্পাদক মেহেদী হাসান, ক্রীড়া সম্পাদক সৈয়দ মাহমুদ, সহ-সম্পাদক আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় নতুন মামলা দায়েরের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে জবরদস্তিমূলকভাবে শাসন ক্ষমতায় এসে বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ভালোভাবেই জানে, জনগণের ওপর অত্যাচার নিপীড়নের মাত্রা বাড়ানোর কারণে এবার ক্ষমতা হারালে আগামীতে ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই। এই চিন্তা মাথায় রেখেই বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এখন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার ও ক্রমাগত জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় নেতাকর্মীদের নামে নতুন মামলা দায়ের করেছে। তবে এসব করে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হবে। তিনি অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।