‘প্রধান বিচারপতিকে দেশত্যাগে বাধ্য করার হুমকি দেয়া হচ্ছে’—হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য

Slider জাতীয় সারাদেশ

 

87081_rana
ঢাকা: প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের আড়াই কোটি ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি শঙ্কিত বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
আজ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। এতে বলা হয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার চরিত্রে কলঙ্কের কালিমা লেপনের অপপ্রয়াস চলেছে ও চলছে। এমনকি তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। লিখিত বক্তব্যে রানা দাশগুপ্ত বলেন, বিগত ৭০ বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কেবল  সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার  মেধা, মনন ও যোগ্যতায় সাংবিধানিক অন্যতম প্রধান পদ অলঙ্কৃত করেছেন। সরকারি দল ও সরকারের একাংশের তীব্র বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে প্রধানমন্ত্রী তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য সুপ্রিম কোর্টের ৭ বিচারপতির সর্বসম্মত একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে টার্গেট করে সরকারি দল ও জোটের মহলবিশেষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে শুধু একতরফা আক্রমণাত্মক, বিদ্রূপাত্মক বক্তব্য উত্থাপন করা হচ্ছে।
পরিষদের সভাপতি হিউবার্ট গোমেজের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন পরিষদের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, কাজল দেবনাথ, অ্যাডভোকেট সুব্রত দেবনাথ, জয়ন্ত সেন দীপু,  জেএম ভৌমিক, মিলন কান্তি দত্ত, পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রবীন্দ্র নাথু বসু, সঞ্জিব দ্রং। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ঐক ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
রানা দাসগুপ্ত বলেন, সুপ্রিমকোর্টের সাতজন বিচারপতির সর্বসম্মত রায়ের  প্রেক্ষিতে আমরা ইতিমধ্যে গভীর দু:খ ও উদ্বেগের সাথে লক্ষ করেছি যে, শুধমাত্র প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে টার্গেট করে সরকারি দল ও জোটের মহল বিশেষ থেকে ব্যাক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে একতরফা, বিদ্রুপাত্মক বক্তব্যই উপস্থাপন করা হয়নি, তার জন্ম পরিচয়, ধর্ম সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি ইত্যাদি পরিচয়ে এমনকি রাজাকারের মিথ্যা অভিধায় উল্লেখ করে বিদ্বেষমূলক সাম্প্রদায়িক উস্কানিও অব্যাহতভাবে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে। তার চরিত্রে কলঙ্কের কালিমা লেপনের অপপ্রয়াস চলছে। এমনকি তাকে দেশ্যত্যাগে বাধ্য করার হুমকিও দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এদেশের আড়াই কোটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সচেতন জনগণের মতোই তা অবাক বিষ্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের কাছে সুষ্পষ্টভাবে মনে হয়েছে যে, সুপ্রিমকোর্টের  সাম্প্রদায়িক রায়কে (ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়) কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতিকে কটাক্ষ করে সরকার, সরকারি দল ও  জোটের দায়িত্বশীল কোন কোন মন্ত্রী এবং নেতাদের বক্তব্য থেকে যেসব বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে তা আওয়ামী ওলামা লীগের বক্তব্যেরই প্রতিফলন।
রানা দাস গুপ্ত বলেন, প্রধান বিচারপতি প্রধান বিচারপতিই। তাঁর ধর্ম বিশ্বাস থাকতে পারে। কিন্তু বিচারপতি হিসেবে তার একমাত্র পরিচিতি তিনি প্রধান বিচারপতি- হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা আদীবাসী নন। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতিসহ যে কোন বিচারপতি বা বিচারকের রায়,   আদেশ নিয়ে মামলার যে কোন পক্ষ বা রাষ্ট্রের কোন নাগরিক সংক্ষুদ্ধ হতেই পারেন। কেই সংক্ষুদ্ধ হলে সংবিধান, আইনে তার প্রতিকারের বিধান যেমন আছে তেমনি রায় বা আদেশ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, তর্ক-বিতর্কও চলতে পারে। তবে, বিচারপতি বা বিচারকের ধর্মবিশ্বাস বা তার সম্প্রদায়গত অবস্থানকে কটাক্ষ করা হলে তা অবশ্যই সেই ধর্মের বিশ্বাসী লোকজন বা সম্প্রদায়কে আহত করে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।
রানা দাসগুপ্ত বলেন, সরকারি দল ও জোটের মহলবিশেষের একাংশের নানা সাম্প্রদায়িক বক্তব্য, মন্তব্য ও উক্তি আপামর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীসহ সচেতন জনমনে ইতিমধ্যে নেতিবাচক বার্তা পৌছে দিয়েছে যা কোনভাবে দায়িত্বশীল কারো কাছ থেকে দেশের জনগণ আশা করেনা, করতে পারেনা। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক ও ব্যাক্তিগত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে যাকে তিনি আর কেউ নন, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বিচার বিভাগের প্রধান। এতে বিচার বিভাগ তথা  গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভিত্তিই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এর পরিণতিতে স্বাধীনতাবিরোধী ও অসাংবিধানিক শক্তির লাভবান হওয়ার শঙ্কা বৃদ্ধি পায়।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আমরা আরও উদ্বিগ্ন এ কারনে যে, প্রধান বিচারপতি ইস্যুকে সামনে রেখে সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মহল বিশেষ সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে তৎপর। পত্রপত্রিকার সংবাদে জানাগেছে সাম্প্রতিককালে প্রধান বিচারপতির রায়কে পূূূঁজি করে সরকারের অভ্যন্তরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল মহল বিশেষ তার ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মকর্তা, কর্মচারিদের পদোন্নতি, উন্নততর পদায়ন ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করার সর্বনাশা প্রক্রিয়া আগের মতোই আবার শুরু করেছে। যার ফলে মেধা, যোগ্যতা, জেষ্ঠ্যতায় এগিয়ে থাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে দারুন হতাশা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতিতে আগর মতোই আবারো বঞ্চনা-বৈষম্যের ধারাটি এগিয়ে আসছে কিনা তা ভেবে সংখ্যালঘু জনগণ শঙ্কিত। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের জনৈক সিনিয়র সচিবের অপতৎপরতার অভিযোগও ইতোমধ্যে উঠে এসেছে।

পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা মনে করি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক ধারা থেকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি প্রকারান্তরে সাম্প্রদায়িক অগণতান্ত্রিক অপশক্তিকে উৎসাহিত করবে। সরকারের ও সরকারি দলের ভেতরকার ঘাপটি মেরে থাকা কোন মহল কোন প্রকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে প্রধান বিচারপতির ইস্যুতে মুলধন করে সাম্প্রদায়িক চক্রান্তে লিপ্ত কিনা তা খতিয়ে দেখতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন জানানো হয় পরিষদের পক্ষ থেকে। এছাড়া দেশের সকল গণতান্ত্রিক, সামাজিক, নাগরিক, সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছেও বিদ্যমান জটিল পরিস্তিতি নিরসনে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *