“নিনিতের জন্য ভালোবাসা”
–খায়রুননেসা রিমি
————ক্লাস ওয়ানে আমি সাধারণত: ক্লাস নেইনা।যখন কোনো টিচার না আসে তখন তার হয়ে প্রক্সি দিতে মাঝে মাঝেই আমাকে ক্লাস ওয়ানে ক্লাস নিতে হয়।বরাবরের মতো আজও আমাকে ওয়ান টিউলিপে ক্লাস নিতে যেতে হলো।ছোটদের ক্লাস নিতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।বাচ্চারাও কেন জানিনা আমাকে খুব পছন্দ করে। ক্লাসে ঢুকতেই সব বাচ্চারা কোরাস কণ্ঠে বলে উঠলো :গুড মর্নিং মিস, :গুড মর্নিং। হাউ আর ইউ? আমার বলার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো। মিস্ আমার না জ্বর এসেছে,কেউ বলছে মিস্ আমারনা ঠাণ্ডা লেগেছে।একেক জন একেক রকম কথা বলছে।হঠাৎ মাঝের বেঞ্চ থেকে একজন দাঁড়িয়ে বলছে, মিস, কেন আই সে সামথিং? আমি বললাম ইয়েস।আমার ইয়েস শোনার সাথে সাথে সে শুরু করে দিল, মিস,জানেন আমি না আপনার সবগুলো বই পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছি।সবগুলো বইয়ের গল্পই আমার মুখস্থ।আপনার লেখা বই- পরীর দেশে যেতে হলে,ভূতছানার বিদ্যা অর্জন,নয়শ’ভূতের কাণ্ড,চুল্লাবুড়ির খপ্পরে,সবগুলো বই ই আমি পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছি।শুধু তাই নয়,এবারের বই মেলার ৩ টা বই ই আমার অনেক বেশি মুখস্থ।মেয়েটি হড়বড় করে কথাগুলো বলতেই লাগলো।আমি তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, :কি নাম বাবা তোমার? :আমার নাম নিনিত।আমি বড় হয়ে আপনার মতো রাইটার হতে চাই।জানেন মিস,আপনার শালিক কন্যার বিয়ে বই টির”ভূতং এখন সাউথ পয়েন্টে”গল্পটি আমার কাছে ইয়াম্মি লেগেছে।ওটাও আমার পুরো মুখস্থ।বিলিভ না করলে আমি আপনাকে গল্পটা মুখস্থ শোনাতে পারি। :তুমি তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে,আমরা আগে ঝটপট আমাদের ক্লাস ওয়ার্কটা শেষ করি তারপর আমরা গল্প করি? :ওকে মিস্। আমি ওদেরকে ক্লাস ওয়ার্ক করতে দিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলাম নিনিত যা বললো তা কতটা সত্যি?এতটুকু একটা ছোট মেয়ে আমার সব বই মুখস্থ করে ফেলেছে?এটা কি করে সম্ভব?নাকি মিসকে ইমপ্রেস করার জন্য বলেছে।আমার এসব ভাবনার মাঝে ছেদ পড়লো বাচ্চাদের কােরাস কণ্ঠে মিস, উই হেভ ডান শুনে। ক্লাস শেষ হতে তখনো ১০ মিনিট বাকী।বাচ্চাদের ক্লাস ওয়ার্ক শেষ করে নিনিতকে কাছে ডাকলাম। :নিনিত সোনা, আমার কোন গল্পটা তোমার বেশি ভালো লেগেছে একটু শোনাওতো দেখি।আমার কথা শুনে নিনিতের মুখটা একেবারে ঝলমলিয়ে উঠলো। মিস,শালিক কন্যার বিয়ের ভূতং এখন সাউথ পয়েন্টে গল্পে ভূতং নামে একটা ভূতকন্যা ছিল।তার খুব ইচ্ছে সাউথ পয়েন্ট স্কুল দেখার।তার বন্ধু পুণ্য সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়ে। তাকে বললেও সে ভূতংকে স্কুলে নিতে কিছুতেই রাজী হয়না।কারণ প্রিন্সিপাল স্যার ও আসমা মিস যদি জানতে পারে পুণ্য একটা ভূত কন্যাকে নিয়ে স্কুলে এসেছে তাহলে ওকে পানিশমেন্ট দিতে পারে।ভূতংয়েরও ইচ্ছে সে স্কুলে যাবেই যাবে।পরদিন ভোর বেলা ভূতং গাছের মগডালে উঠে বসে আছে স্কুলে যাবে বলে।পুণ্যর বাবার মোটর সাইকেলের শব্দ শুনে সাঁই করে গিয়ে মোটর সাইকেলে চড়ে বসলো। হাত নেড়ে নেড়ে, কখনো লাফ দিয়ে অভিনয় করে করে পুরো গল্পটি বলছে।পুরো ক্লাসে পিনতন নীরবতা।মুগ্ধ হয়ে স্টুডেন্টসরা তার গল্প শুনছে।সেই সাথে আমিও।তার গল্প বলার স্টাইল,ননস্টপ পুরো গল্প বলতে পারা এটা যে কত বড় যোগ্যতা এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এতটুকু একটা ছোট বেবি আমার লেখা বই পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছে এটাও আমার অনেক বড় প্রাপ্তি।আমি নিনিতের গল্প বলা থামিয়ে দিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।ভীষণ ভালো লাগলো তার গল্প বলা। ঢং করে ঘন্টা বাজতেই আমি একরাশ ভালোলাগা নিয়ে ওয়ান টিউলিপ থেকে বেরিয়ে এলাম। পরদিন টিচার্স রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে নিনিত হাত ইশারায় আমাকে ডাকছে। কাছে যেতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, মিস,আমি না আপনাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি।এটা আপনার জন্য।আপনিও কিন্তু আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবেন।লিখবেনতো? অবশ্যই লিখব।কেন নয়? এরপর থেকে নিনিতের সাথে দেখা হলেই নিনিত জানতে চায়,মিস্ আমাকে নিয়ে লেখা গল্পটা কি শেষ হয়েছে? আমি চুপ থাকি।বলি লেখা চলছে। আসলে নিনিতদের মতো বই পড়ুয়া বেবি আজকাল খুব একটা চোখে পড়েনা।সবাই ট্যাবে গেইমস খেলতেই পছন্দ করে।তারা এখন দিনরাত শিনচেন, ডোরেমন দেখা নিয়ে বিজি।বই পড়ার সময় তাদের নাই। নিনিত শুধু আমার লেখা বই ই পড়েনা, অন্য বড় বড় লেখকদের শিশুসাহিত্যও পড়ার চেষ্টা করে। স্যালুট নিনিতের বাবা মাকে।এত অল্প বয়সে তার ভিতরে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য। স্যালুট আমার ভীষণ প্রিয় ক্ষুদে পাঠক নিনিতকেও। অনেক ভালোবাসা তোমার জন্য।বইয়ের আলোয় আলোকিত হোক তোমার জীবন।