ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচনে তিন সদস্যের প্যানেল মনোনীত করতে সিনেটের ২৯ জুলাই ডাকা বিশেষ সভার নোটিশ অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সেই সভায় তিন সদস্যের মনোনীত প্যানেলকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তা ছাড়া আগামী ছয় মাসের মধ্যে ‘যথাযথভাবে সিনেট গঠনের’ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হাইকোর্ট নির্দেশও দিয়েছেন।
গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ রায় দেন।
আদালতের এই রায়ের পর একটা বিষয় পরিষ্কার, যেনতেনভাবে বা অপূর্ণাঙ্গ সিনেটে উপাচার্য প্যানেল গঠন করা যাবে না। সিনেটকে হতে হবে ‘যথাযথ’ আইন অনুযায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী। সেই অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কেমন হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। তবু বিভিন্ন সময় এই অধ্যাদেশ পাশ কাটিয়ে উপাচার্যরা সিনেট অধিবেশন ডেকেছেন। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলেও আইন পাশ কাটানোর পুরোনো নজির তুলে উপাচার্যরা একই কাজ করেছেন। ফলে ১৯৯১ সালের পর গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময় কখনোই আর সিনেট পূর্ণাঙ্গ করা হয়নি।
অধ্যাদেশের ২০(১) ধারা অনুযায়ী, সিনেটের ১০৫ জন সদস্যের মধ্যে থাকবেন উপাচার্য, দুজন সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সরকার মনোনীত পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তা, জাতীয় সংসদের স্পিকার মনোনীত ৫ জন সাংসদ, আচার্য মনোনীত ৫ জন শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেট মনোনীত ৫ জন গবেষক, একাডেমিক কাউন্সিল মনোনীত অধিভুক্ত কলেজের ৫ জন অধ্যক্ষ ও ১০ জন শিক্ষক, ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান, ২৫ জন নির্বাচিত রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, ৩৫ জন নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি এবং ডাকসু মনোনীত ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট পূর্ণাঙ্গ না করার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন না হওয়া। ১৯৯১ থেকে গত ২৭ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়নি। ফলে ওই সময়ে দায়িত্ব পালন করা কোনো উপাচার্যের আমলেই সিনেট ‘যথাযথ’ হয়নি। আইন অনুযায়ী সিনেট চলামান কমিটি। এটি সব সময় থাকবে। কিন্তু সময়–সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও যদি সিনেটের কোনো শূন্য পদ পূরণ না হয়, তাহলে সেই সিনেটকে যথাযথ বলা যায় না।
গত ২৯ জুলাই সিনেটের ‘বিশেষ সভায়’ উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করা হয়েছিল। সেখানে প্যানেলে ওই সময়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বর্তমান কোষাধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন এবং আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের আহ্বায়ক আবদুল আজিজ।
ওই দিনের সভায় উপাচার্য নিয়োগ প্যানেল করা দুটি কারণে অবৈধ। এক. বিশেষ সভার নোটিশ আইনি প্রক্রিয়া মেনে হয়নি। আর সিনেটে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের মাধ্যমে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটসহ বেশ কিছু পদ পূরণ করা হয়নি।
বিশেষ সভার নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষকসহ ১৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট রিট করেন। তাই আদালতে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের রিটের কারণে এখন মনে হতে পারে আদালতের আদেশ অনুযায়ী কেবল আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই নির্বাচন করলেই চলবে। কিন্তু আদালতে বক্তব্যে ‘যথাযথ’ভাবে সিনেট গঠনের কথা বলা হয়েছে। আর সেটা হতে হলে ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধিও সিনেটে রাখতে হবে। সেটি না হলে ’৭৩-এর আইন অনুযায়ী সিনেট যথাযথ হয়েছে, তা বলার সুযোগ থাকে না।
রায়ের পর আলাপকালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকও বললেন একই কথা। তাঁর মতে, আদালত সিনেটকে যথাযথ করতে বলেছেন। এর মানে এখন সিনেট যথাযথ নয়। এ কারণে এই রায়ের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেট গঠনে বাধ্যবাধকতা চলে এল। কেননা, আইনে সিনেট বলতে ১০৫ জন সদস্যকেই বোঝানো হয়েছে। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি সিনেট পূর্ণাঙ্গ না করার মানসিকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের থাকে, তাহলে সেটা আইনের পরিপন্থী হবে। আদালতের এই রায়ের পর রেজিস্টার্ড ও অন্যান্য কমিটির নির্বাচন করা যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি ডাকসুর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হবে।
বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেলেন, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে সিনেটে পাঁচজন প্রতিনিধি না থাকলে ভবিষ্যতে সেই সিনেটও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।