এ বছরের দুটি বিভাগের নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা জাপানের নাগাসাকি শহরের জন্য বিশেষভাবে আনন্দদায়ক হয়ে এসেছে। বিভাগ দুটি হচ্ছে শান্তি আর সাহিত্য। হিরোশিমার পাশাপাশি আণবিক বোমা হামলায় বিধ্বস্ত জাপানের দ্বিতীয় শহর নাগাসাকিও অনেক দিন থেকেই পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। শহরের সেই শান্তি অন্বেষণ প্রচেষ্টার নেতৃত্বে আছেন হিবাকুশা নামে পরিচিত আণবিক বোমা হামলার শিকার হওয়ার পর বেঁচে থাকা নগরবাসী।
এবারের শান্তির নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার আগে এ রকম কানাঘুষা জাপানে শোনা যাচ্ছিল যে হিবাকুশাদের ভাগ্যে মিলেও যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত সেই পুরস্কার, যদিও পুরস্কারের আশায় এঁরা তাঁদের শান্তির জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখেননি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হিবাকুশাদের ভাগ্যে সেই পুরস্কার জোটেনি। তবে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকির হিবাকুশারা কিন্তু এ জন্য কোনো রকম হাপিত্যেশ করছেন না। কেননা, যে সংগঠনটিকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, হিবাকুশারা সেই সংগঠনের সূচনা থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত আছেন এবং এ বছর জাতিসংঘে গৃহীত পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তির বাস্তবায়নে পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির জোট ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস বা আইক্যানের ভেতরে এবং বাইরে থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে গেছেন জাপান সরকারের চুক্তির বিরোধিতা করে যাওয়া সত্ত্বেও।
হিবাকুশাদের মধ্যে যাঁরা আজও জীবিত আছেন, তাঁদের গড় বয়স এখন ৮০ বছর ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সংগতভাবেই ধারণা করা যায় যে আগামী কয়েক বছরে হারিয়ে যাবে সাত দশকের বেশি সময় ধরে শান্তির জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করে যাওয়া জাপানের এই প্রজন্ম। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে সম্ভাব্য বিজয়ীদের তালিকায় বেশ কয়েকবার এঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত থেকে গেলেও ক্ষেত্রবিশেষে অশান্তির বাদশাহদের পুরস্কার দেওয়া হলেও কোনো এক অজানা কারণে হিবাকুশাদের নাম বিজয়ীর তালিকায় কখনো ওঠেনি। তাই এবারের বিজয়ী সংগঠনের সঙ্গে হিবাকুশাদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ থেকে যাওয়ায় সেই ঘাটতি সম্ভবত আংশিকভাবে পূরণ করে নেওয়া গেছে।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণায় আনন্দ প্রকাশ করেছেন নাগাসাকি আর হিরোশিমার হিবাকুশারা। তাঁরা মনে করছেন, বিশেষ করে এখনকার এই সময়ে আইক্যানের পুরস্কার লাভ হচ্ছে পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তি চুক্তির প্রতি বলিষ্ঠ এক নৈতিক সমর্থন। পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী দেশগুলোর কোনোটিই সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর তো করেইনি, বরং শুরু থেকেই চুক্তির বিরোধিতা করে চলেছে। পাশাপাশি জাপানের মতো পরমাণুর ছত্রচ্ছায়ায় থাকা কিছু দেশও চুক্তি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। সে রকম অবস্থায় চুক্তিটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব না হলেও অন্তত নৈতিক দিক থেকে সেই চুক্তির বিরোধিতাকারীদের কিছুটা হলেও অস্বস্তিকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এখন এদের সেই অস্বস্তিকে নিশ্চিতভাবেই আরও অনেকটা বাড়িয়ে দেবে।
এ বছরের নোবেল পুরস্কার নিয়ে জাপানের নাগাসাকি শহরের উৎফুল্ল হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। এবারে সাহিত্যের পুরস্কার পেয়েছেন জাপানে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক কাজুও ইশিগুরো। ইশিগুরো জাপানি ভাষার লেখক নন। তাঁর সাহিত্যকর্মের সবটাই ইংরেজি ভাষায় এবং থাকছেনও তিনি বিলেতে। ফলে তাঁকে জাপানি লেখক হিসেবে দাবি করার কোনো সুযোগ জাপানের সামনে সেভাবে নেই। অন্যদিকে ইশিগুরো নিজে তাঁর জাপানি পরিচয় সম্পর্কে সচেতন থাকলেও নিজেকে জাপানি লেখক বলে তিনি দাবি করেন না। বরং অনেক ক্ষেত্রে জাপান সম্পর্কে সমালোচনামূলক কিছু মন্তব্য তাঁকে করতে দেখা গেছে। ২০১৫ সালে রাখা এক বক্তব্যে তিনি যেমন বলেছিলেন:
‘জাপানের থেকে অনেকটা দূরত্বে আমার অবস্থান হওয়ায় দেশটির দিকে আমি চোখ রাখছি দূর থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে জাপানের সঙ্গে চীন ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সংঘাত সব সময় চলছে। জাপানিরা মনে হয় তাঁরা যে আগ্রাসী ছিলেন এবং জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী চীন ও এশিয়ার দক্ষিণাংশে যা কিছু করেছে, তা ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
এ রকম মন্তব্য সত্ত্বেও নিজের জাপানি পরিচয় নিয়ে তিনি সচেতন। যেসব বিষয় তাঁর লেখায় মূলত উঠে আসছে, সেগুলোর মধ্যে ইতিহাসের অবস্থান হচ্ছে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম উপন্যাস আ পেইল ভিউ অব হিলস তিনি লিখেছিলেন নাগাসাকিকে ঘটনার পশ্চাতে রেখে। ব্রিটিশ নাগরিককে বিয়ে করে বিলেতে চলে যাওয়া নাগাসাকি শহরের এক জাপানি রমণী হচ্ছেন সেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যার স্মৃতির মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছে নাগাসাকির আণবিক বোমা হামলার কথা। দ্বিতীয় উপন্যাস দি আর্টিস্ট অব আ ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড–এর কাহিনিও জাপানকে ঘিরে। যে শিল্পীর কথা তিনি সেই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন, লেখকের কল্পনার সেই চরিত্রের সঙ্গে সাহিত্যের বিশ্লেষকদের কেউ কেউ জাপানের আভানগার্দ শিল্পী লিওনার্দ ফুজিতার মিল খুঁজে পেলেও লেখক নিজে কখনো তা দাবি করেননি।
ইশিগুরোর কাছে ইতিহাস ভিন্ন এক মাত্রা নিয়ে উপস্থিত। নিজে তিনি যেমন তাঁর কাহিনির পেছনে ইতিহাসের উপস্থিতি সম্পর্কে একসময় বলেছিলেন, ‘আমার লেখায় যে বিষয়টিকে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, তা ইতিহাস হলেও কেবল ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা সেটা নয়; বরং তা হচ্ছে বিভিন্ন দেশ, জাতি ও সমাজ কীভাবে অতীতকে মনে রাখে এবং একই সঙ্গে কীভাবে প্রায়শই নিজের অস্বস্তিকর অতীতকে মাটিচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে—ইতিহাসের সেই দিকটি।’
সূচনার জাপানভিত্তিক পটভূমির দুই উপন্যাসের পর জাপানের কাহিনিতে লেখক আর কখনো ফিরে যাননি। তাঁর পরের সব কটি উপন্যাসই হচ্ছে বিশুদ্ধ অর্থে পশ্চিমের জীবনকেন্দ্রিক। শুধু তা–ই নয়, রিমেইন্স অব দি ডে উপন্যাসকে অনেকেই দেখেন একেবারে খাঁটি ইংরেজি উপন্যাস হিসেবে, একালের বিলুপ্তপ্রায় অভিজাত সম্প্রদায়ের গৃহে বাটলারের কাজ করা এক ব্যক্তি হচ্ছে যে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।
নিজের উপন্যাসে পরবর্তী সময়ে জাপানকে তুলে না ধরলেও জাপান এখন ইশিগুরোকে কাছে ডাকছে। লেখকের পারিবারিক পরিচয় অবশ্যই হচ্ছে এর প্রধান কারণ। তবে তা সত্ত্বেও নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিজের এই দেশত্যাগী সন্তানকে জাপান কিন্তু সেভাবে মনে রাখেনি। পুরস্কার ঘোষণার দিনও জাপানের দৃষ্টি পুরোটাই ছিল হারুকি মুরাকামির দিকে, এবারও যাঁকে (তিনিও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের একজন ছিলেন) এর তালিকায় থাকতে হচ্ছে।
কাজুও ইশিগুরোকে নিয়ে জাপানের এই সার্বিক বিস্মৃতির মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে নাগাসাকি শহর। পাঁচ বছর বয়সে মা–বাবার সঙ্গে বিলেতে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ইশিগুরোর পরিবার নাগাসাকিতেই বসবাস করছিল। সেই সূত্রে নাগাসাকির কিছু মানুষ এখনো তাঁদের মনে রেখেছেন। লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শুরুর দিনগুলোতে একবার নাগাসাকি সফরে এসে অতীতের যেসব যোগসূত্রের সঙ্গে নতুন করে ইশিগুরোর সংযোগ ঘটেছিল, সেই দলে আছেন ৯১ বছর বয়সী মহিলা তেরুকো তানাকা। এই নারী একসময় ছিলেন নাগাসাকির সাকুরাগাওকা কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক। মা–বাবার হাত ধরে বিদেশে চলে যাওয়ার আগে সেই কিন্ডারগার্টেনেই ইশিগুরো ভর্তি হয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জাপান ভ্রমণে এসে কিন্ডারগার্টেনের সেই শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি এবং দেশে ফিরে গিয়ে নিজের স্বাক্ষর করা একটি উপন্যাস তিনি তাঁর এই শিক্ষকের জন্য পাঠিয়েছিলেন।
তেরুকো তানাকা এখনো তাঁর সংগ্রহে সেই উপন্যাসটি রেখেছেন। দূর অতীতে একসময় তাঁর কিন্ডারগার্টেনের সেই ছাত্রের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভের সংবাদে এতটাই উৎফুল্ল তিনি বোধ করেন যে রাতে ভালোভাবে ঘুমাতেও পারেননি। ইশিগুরোর নোবেল পুরস্কারের সংবাদ প্রচুর আনন্দ তাঁকে জীবনের এই শেষবেলায় দিয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেও নোবেল পুরস্কার লাভ করায় ইশিগুরোকে অভিনন্দন জানিয়ে উল্লেখ করেছেন যে জাপানে তাঁর অনেক ভক্ত রয়ে গেছে। অন্যদিকে নাগাসাকির মেয়র তোমোহিসা তাউয়ে তাঁর অভিনন্দনবার্তায় আশা প্রকাশ করেছেন যে কাজুও ইশিগুরো শিগগিরই আবার নাগাসাকি সফরে আসবেন।