বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চায়। রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করতে রাজি হয়েছে দেশটি। দীর্ঘদিনের এই সমস্যা সমাধানের মানদণ্ড ঠিক করতে মিয়ানমারের কাছে একটি চুক্তির খসড়া দিয়েছে বাংলাদেশ।
গতকাল সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়ে এসব আলোচনা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বৈশ্বিক চাপে মিয়ানমারের অবস্থান কিছুটা নমনীয় হয়েছে।
গতকালের আলোচনায় বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। তবে বাংলাদেশ বলছে, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত আশ্রয় নেওয়া ৯ লাখের বেশি রোহিঙ্গার সবাইকে ফেরত নিতে হবে। যদিও মিয়ানমার এই মুহূর্তে গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত আসা প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা আর নিবন্ধিত ২ হাজার ৪১৫ জন শরণার্থীকে ফেরানোর কথা বলছে।
এদিকে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়াই এখন তাঁদের প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় গতকাল জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার নির্বাহী কমিটির সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনের সীমান্তচৌকিতে হামলার পর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ শুরু করে। এরপর থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ বছরের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির বিশেষ দূত চাও টিন এবং জুলাইয়ে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং তুন বাংলাদেশে আসেন। তবে দুই আলোচনাতেই কোনো জোরালো প্রস্তাব নিয়ে আসেননি মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা। কিন্তু ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিন দফা আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ ও জোট এ নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে।জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের পাশাপাশি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল’ হিসেবে অভিহিত করেছে। আন্তর্জাতিক জনমতের কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চাপ অনুভব করছে মিয়ানমার। এই চাপের কারণে দেশটি নিজেদের অবস্থান কিছুটা হলেও পরিবর্তন করেছে।
রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ওই বৈঠকের পর মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিয়ানমার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য দুই পক্ষ একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে রাজি হয়েছে। আলোচনা করে এর গঠন প্রক্রিয়া ঠিক করা হবে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সহায়তার লক্ষ্যে আমরা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির খসড়া তাদের দিয়েছি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সীমান্ত ও নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুব শিগগিরই মিয়ানমারে যাবেন। উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চায়।
জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) কাজ কবে শুরু হবে আর কত দিনের মধ্যে শেষ হবে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দুই পক্ষ জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে রাজি হয়েছে। দুই পক্ষ তাদের প্রতিনিধিদের নাম দেবে। তবে খুব তাড়াতাড়ি তা হবে।
জাতিসংঘকে যুক্ত করা হচ্ছে না
রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় যে জেডব্লিউজি গঠন করা হচ্ছে, তাতে জাতিসংঘ থাকছে না। গতকাল এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী স্পষ্ট করেই বলেছেন, এটার মধ্যে তো জাতিসংঘ আসছে না।
গতকালের বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাসহ (ইউএনএইচসিআর) জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর ব্যাপারে মিয়ানমারের লোকজনের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এ কথা চ টিন্ট সোয়ে উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে বড়জোর রেডক্রসকে যুক্ত রাখার কথা বলছেন মিয়ানমারের মন্ত্রী।
বিবেচনায় গ্রামের নাম
রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার আগে তার নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা সব সময় বলে আসছে মিয়ানমার। এ পর্যন্ত নিবন্ধিত শরণার্থীদের মধ্যে ২ হাজার ৪১৫ জনের নাগরিকত্বের বিষয়টি অনেক আগেই চূড়ান্ত হয়ে আছে। কাজেই তাদের ফেরানোর ক্ষেত্রে নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের কথা আসবে না। এবার আসা ৫ লাখের বেশি আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের সহিংসতার পর আসা ৮৭ হাজার রোহিঙ্গার নাগরিকত্বের সুরাহা কীভাবে হবে—এ প্রশ্নটা ঘুরেফিরেই আসছে। এ নিয়ে গতকালের বৈঠকে কথা উঠলে মিয়ানমার জানিয়েছে, পালিয়ে আসা লোকজন তাদের গ্রামের নাম বললেই চলবে। এ কথার জবাবে বাংলাদেশ প্রশ্ন তোলে, যেখানে গ্রামই পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, তাদের ঠিকানা আসবে কোথা থেকে? মিয়ানমার তখন বলেছে, গ্রাম আর পাড়ার নাম বললেই হবে। ওইটুকু ঠিকানাই তাদের রাখাইনের বাসিন্দা হিসেবে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট।
মংডুর জনসংখ্যা
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রস্তাব দিলেও আপাতত গত অক্টোবর থেকে আগস্টের পর আসা লোকজনের কথা বলছে। সেই সঙ্গে যুক্ত করেছে আগে থেকে চূড়ান্ত হওয়া ২ হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে। কিন্তু বাংলাদেশের স্পষ্ট অবস্থান শুধু ২ হাজার ৪১৫ জন শরণার্থী এবং অক্টোবর থেকে আগস্টের পর থেকে আসা রোহিঙ্গাই নয়, ১৯৯২ সালের পর আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গার সবাইকে ফিরিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশের এই অবস্থানের পর মিয়ানমার বলছে, শুরুতে নতুনদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। পরে যাচাই-বাছাই শেষে ফিরিয়ে নেওয়া হবে পুরোনোদেরও। আলোচনার একপর্যায়ে বাংলাদেশ রাখাইনের বিভিন্ন এলাকার জনসংখ্যা সম্পর্কে জানতে চায়। তখন উত্তর রাখাইনের মংডুর কথা উল্লেখ করে মিয়ানমারের প্রতিনিধি জানান, সেখানে প্রায় ৬ লাখের বসতি ছিল, যাদের ৯০ শতাংশই রোহিঙ্গা।
‘ভৌতিক শহরে’ কূটনীতিকেরা
এদিকে ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, চ টিন্ট সোয়ে যখন ঢাকায় মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করছেন, একই সময়ে মিয়ানমারে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের রাখাইন সফরে নিয়ে গেছে সে দেশের সরকার। সরকার আয়োজিত ওই সফরে গিয়ে জনমানবহীন মংডু শহরকে ‘ভৌতিক শহর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বেশ কয়েকজন কূটনীতিক। এ ছাড়া হেলিকপ্টারে করে রাখাইনের পোড়া গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গতকাল দুপুরে তাঁরা ধোঁয়া ওড়ার কথা জানিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি মিলিয়ে প্রায় ৬০ জন রাখাইনে যান।
রোহিঙ্গারা আসছেই
রাখাইন রাজ্যে এখনো রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চলছে বলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছে। তারা বলছে, জনশূন্য হয়ে পড়া রোহিঙ্গা গ্রামগুলো দেশটির সেনাবাহিনী দখলে নিচ্ছে। নতুন করে পালিয়ে এসেছে ২০ জন রোহিঙ্গা। স