কারিগরি দক্ষতা থাকলেও ভাষার দক্ষতায় অন্যদের চেয়ে বেশ পিছিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকরা। এর প্রভাব পড়ছে তাদের আয়ে। একই ধরনের কারিগরি ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কাজ শুরু করলেও শুধু ভাষার দক্ষতায় বাংলাদেশীদের চেয়ে বেশি উপার্জন করছেন অন্যান্য দেশের প্রবাসী শ্রমিকরা।
প্রবাসী আয় বাড়াতে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যবহারিক ভাষা শিক্ষণের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশীরা বিভিন্ন দেশে গেলেও সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষার সঙ্গে পরিচিতি না থাকায় পদোন্নতির সুযোগ হচ্ছে কম। ভাষাগত দক্ষতা থাকায় সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছেন অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ভারত, শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনের নাগরিকরা। এতে আয়ও বাড়ছে তাদের।
বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেন জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব রুহুল আমিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রেমিট্যান্সের বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের ৮১ শতাংশই কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু এসব দেশের প্রচলিত ভাষা আরবিতে দক্ষ নন তারা। ভাষাগত দক্ষতার অভাবে তাদের নিম্ন বেতনের কাজ করতে হচ্ছে। অথচ একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে শুধু আরবি জানার কারণে অন্য দেশের কর্মজীবীরা সেখানে বেশি আয় করছেন। এটা দূর করতে কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ভাষাগত শিক্ষারও গুরুত্ব রয়েছে।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের মাথাপিছু আয় কম হওয়ার তথ্য দিয়েছে বিশ্বব্যাংকও। গত বছর প্রকাশিত সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকের মাথাপিছু আয় ছিল বার্ষিক ২ হাজার ৭৮ ডলার। অন্যদিকে একজন ভারতীয় অভিবাসীর এ আয় ৫ হাজার ১৯৪, নেপালের ৩ হাজার ৩০০ ও পাকিস্তানের ৩ হাজার ২৪১ ডলার। প্রবাসী আয়ে এগিয়ে থাকা আরেক দেশ ফিলিপাইনের শ্রমিকদের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ৯৫০ ডলার।
ভাষাগত দুর্বলতার পাশাপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতিকেও প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের আয় কম হওয়ার কারণ বলে মনে করেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক ড. সি আর আবরার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা কম। শিক্ষার পাশাপাশি ভাষাগত দুর্বলতা থাকায় তাদের পদোন্নতিও সেভাবে হচ্ছে না। ফলে কম মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে ভারত বা শ্রীলংকা থেকে যাওয়া শ্রমিকরা শিক্ষা ও ভাষাগত দক্ষতার কারণে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম দিকে সাধারণ কর্মী পদে যোগদান করলেও ভাষাগত দক্ষতার জোরে ব্যবস্থাপনা পদে উন্নীত হচ্ছেন তারা। ফলে বাংলাদেশীদের তুলনায় তাদের আয়ও বেশি হচ্ছে।
রেমিট্যান্স বাড়াতে ভাষা প্রশিক্ষণের গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে গত ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকেও। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) মো. আমিনুল ইসলাম বৈঠকে জানান, বিদেশ গমনেচ্ছুদের ভাষার প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে পাঠিয়ে সেখানকার বাজার ধরার জন্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে রেমিট্যান্স বাড়ানোই ভাষা শিক্ষণ প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ৩৪টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে বিদেশগামী কর্মীদের কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যবহারিক ভাষা শিক্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য দরকার হলে বিদ্যমান কোর্সের মেয়াদও বাড়ানো হবে। শিগগিরই ঢাকায় তিনটি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে রুশ ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জাপানি ভাষা শিক্ষার জন্য সে দেশের সরকারের অর্থায়নে ও জাইকার সহায়তায় প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)।
বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কোরিয়াগামী ৪৮৮ জন কর্মীকে কোরিয়ান ভাষায়, হংকংগামী ১ হাজার ৩১২ জনকে ক্যান্টনিজ ভাষায় ও ২৬৯ জনকে ইংরেজি ভাষায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আরবি ভাষার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যগামী ৭৩ হাজার ৬২৩ জন।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিদেশগমন প্রতি বছরই বাড়ছে। ২০১৫ সালে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন বাংলাদেশী বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমালেও ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জনে। আর চলতি বছরের প্রথম আট মাসে বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ৬ লাখ ৯০ হাজার বাংলাদেশী।
জনশক্তি রফতানি বাড়লেও কমছে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণ ১৪ শতাংশের বেশি কমেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর প্রবাসীরা ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার দেশে পাঠালেও গত অর্থবছর পাঠিয়েছেন ১ হাজার ২৭৭ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।