কিছুদিন আগে ঢাকার বাংলামোটরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের এক সার্জেন্টের সহিংস বাগ্বিতণ্ডা হয়েছিল। কারণ, তারুণ্যের তেজে অস্থির ওই শিক্ষার্থীরা ঢাউস আকারের দোতলা বাসে করে যাতায়াত করেন সড়কের উল্টো দিক দিয়ে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা সাধারণত তাঁদের বাধা দেন না, কিন্তু সেদিন ওই সার্জেন্ট তাঁদের বাধা দিয়েছিলেন। ফলে তেজি তরুণের দল তাঁর ওপর চড়াও হয়েছিলেন।
ঘটনার পরদিন সেই ট্রাফিক সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি বাংলামোটরে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে তাঁকে পাইনি। কথা বলেছিলাম তাঁর এক সহকর্মীর সঙ্গে, যিনি ওই মুহূর্তে সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁকে বলেছিলাম, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাবল ডেকার বাস উল্টা দিক দিয়ে যাওয়ার সময় আপনারা তো বাধা দেন না, গতকাল হঠাৎ কী মনে করে বাধা দেওয়া হয়েছিল?’
যুবক সার্জেন্ট হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘সব সময় পারা যায় না, কিন্তু আমরা চেষ্টা করি।’
আমার পরবর্তী জিজ্ঞাসা ছিল, ‘এই রাস্তায় উল্টো দিক দিয়ে যখন পুলিশ কর্মকর্তাদের গাড়ি যায়, তখন কি আপনারা সে গাড়ি থামান?’ উত্তর ছিল, ‘পুলিশের গাড়ি থামানোর নিয়ম নাই।’
‘পুলিশের ভ্যান নয়, কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত গাড়ি বা জিপ?’
‘তা-ও থামাই না।’
‘আর কার কার গাড়ি আপনারা থামান না?’
তিনি যে তালিকা বলেছিলেন, তা স্মৃতি থেকে লিখছি, ‘মন্ত্রী মহোদয়, জজ সাহেব, সচিব স্যার, সরকারি যত বড় বড় স্যার আছে, তারপরে আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্সের স্যারেরা আছে…।’
‘সাংবাদিক?’
‘তারা তো সাংঘাতিক। মিডিয়ার গাড়ির কাজই হলো রং সাইড দিয়ে যাওয়া। তারা কিছুই মানে না।’
তিনি আমাকে আরও বলেন, উল্টো পথে যত গাড়ি চলাচল করে, তাঁর অনুমান, সেসবের ৯৫ শতাংশই বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতার গাড়ি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাদের প্রতি কি এমন কোনো নির্দেশ আছে যে তাঁদের গাড়িকে বাধা দেওয়া চলবে না?’
উত্তর: ‘না, সেই রকম কোনো অর্ডার নাই। আমরা নিজেরাই আটকাই না।’
‘কেন আটকান না? উল্টো পথে গাড়ি চালানো আইনত নিষিদ্ধ না? এর জন্য শাস্তির বিধান আছে না?’
‘হ্যাঁ, এটা বেআইনি। কিন্তু ভাই, বোঝেনই তো, আমাদের তো চাকরি বাঁচাতে হবে।’
তারপর আমি শাহবাগ মোড়ে, কাঁটাবন মোড়ে ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের তিনজন সদস্যের সঙ্গে একই প্রসঙ্গে আলাপ করে একই ধরনের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছি। উল্টো পথে চলা বড় কর্মকর্তাদের গাড়ি আটকালে ট্রাফিক পুলিশের চাকরিই নট হয়ে যাবে—এই আশঙ্কা নিশ্চয়ই অতিরঞ্জিত। তবে ‘ঠেলা’, ‘ধাতানি’, ‘শানটিং’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে তাঁরা যে প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তা সম্ভবত অমূলক নয়। মূলত সেই কারণেই রাজধানীর রাস্তাঘাটে রাঘববোয়ালদের গাড়িগুলো উল্টো পথে অবাধে চলাচল করে এবং তার ফলে যানজট আরও বেড়ে যায়।
এটা যখন ঢাকা মহানগরের ‘স্বাভাবিক’ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে, তখন প্রথম পাতায় সংবাদ শিরোনাম এল, ‘সাংসদ, আমলাদের গাড়ি পুলিশের জালে’। প্রথম পাতায় সংবাদ শিরোনাম হওয়ার মতো খবরই বটে: রোববার রাজধানীর মন্ত্রীপাড়ায় হেয়ার রোডে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ আকস্মিকভাবে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টায় ৫৭টি মোটরগাড়ি আটকায়। ৪০টি গাড়িই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। প্রতিমন্ত্রী, সচিব, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিক ও বিচারক—এই সব পদ ও অবস্থানের ব্যক্তিদের গাড়িগুলো যাচ্ছিল সড়কের উল্টো দিক দিয়ে, যা কোনো সভ্য সমাজে অকল্পনীয় কিন্তু এই দেশে নিত্যদিনের স্বাভাবিক দৃশ্যে পরিণত হয়েছে।
লক্ষ করার বিষয়, সেদিন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা যখন বড় বড় মানুষের গাড়িগুলো আটকাচ্ছিলেন, তখন বাস ও অন্যান্য যানবাহনে ওই পথ দিয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষ চিৎকার করে ‘সর্বোচ্চ’ শাস্তির দাবি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশ কাকে শাস্তি দেবে? উল্টো পথে গাড়িগুলো যাঁরা চালাচ্ছিলেন, তাঁরা তো প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ, সচিব, জজ সাহেব বা সাংবাদিক নন। ওই অবৈধ কাজ করছিলেন তাঁদের গাড়িচালকেরা, তাই মামলা আর জরিমানা করা হলো চালকদের। ট্রাফিক পুলিশের ক্ষমতা ওই পর্যন্তই: গাড়ির ভেতরে সমাসীন বড় বড় মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার স্পর্ধাও সম্ভবত তাঁদের নেই।
বড় বড় মানুষের গাড়িচালকদের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের এহেন ব্যতিক্রমী ব্যবহার চালকদের জন্য ছিল বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। তাঁরা ভাবতেও পারেননি, তাঁদের স্যার ও ম্যাডামরা গাড়িতে থাকা অবস্থায় ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্য সেই গাড়ি আটকাতে পারেন, এমনকি চালককে গাড়ি থেকে নামতে বলতে পারেন। তাই পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মাফরুহা সুলতানার গাড়ি থামিয়ে তাঁর চালক বাবুল মোল্লাকে যখন গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়, তখন তিনি কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘নতুন কোনো আইন হইছে নাকি?’ অর্থাৎ তিনি ধরে নিয়েছিলেন, সচিব মহোদয়-মহোদয়াগণের গাড়ি উল্টো পথে চলবে, এটাই বর্তমানে প্রচলিত আইন; এ আইন বদলাতে হলে নতুন আইনের প্রয়োজন হবে। চালক বাবুল মোল্লার জন্য আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ তাঁর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। সচিব মাফরুহা সুলতানা ওই সময় গাড়িতেই উপবিষ্ট ছিলেন, তিনি সবকিছু প্রাণভরে অবলোকন করেছেন এবং সম্ভবত ভেবেছেন যে তাঁর গাড়িচালকের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের ওই সদস্যটি নাট্যাভিনয় করছেন এবং সেই নাটকটি ছিল একটি প্রহসন।
তাই সচিব মহোদয়া, তাঁর চালকের ওপর বিরূপ হননি, তাঁকে বরং প্রশ্রয়ই দিয়েছেন। তাঁর মহানুভবতার তুলনা হয় না। ফলে বাবুল মোল্লা পরদিন আবারও তাঁর ম্যাডামকে নিয়ে উল্টো পথেই গাড়ি হাঁকালেন এবং এবার ট্রাফিক পুলিশ বাংলামোটরে গাড়িটা আটকে দিল। এবার তাজ্জব বনে গেছেন স্বয়ং ট্রাফিক পুলিশ। তাঁর বিস্ময়োক্তি, ‘এ কেমন কথা! সমবায়সচিব ম্যাডামকে কালকেই ধরলাম, মামলা হলো। আজ আবারও তিনি উল্টো পথে এসে ধরা পড়েছেন!’
আবারও ধরা পড়েছেন এই কারণে যে তাঁর চোখের পর্দা নেই। তাঁর মতো যাঁরা উল্টো পথে গাড়ি চালানোকে নিজেদের স্বাভাবিক অধিকার ভাবেন, তাঁদের সবারই চোখের পর্দা লোপ পেয়েছে। এটা একটা রোগ। এই রোগের জীবাণু থাকে পদ, ক্ষমতা, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি যা কিছু একজন মানুষকে আর দশজন সাধারণ মানুষের তুলনায় উঁচুতে তোলে বা সে রকম তাঁরা মনে করেন, সেসবের মধ্যে। সাংবাদিকদের যদিও এসব কিছু নেই, তবু তাঁদেরও একটা অংশ এই রোগে ভীষণভাবে ভুগছেন।
চোখের পর্দা উবে গেলে জনসমক্ষে নিজের বেহাল দশা দেখেও মানুষ লজ্জা পায় না। উপরন্তু কেউ কেউ নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার (এনপিডি) নামে আরও এক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যার বৈশিষ্ট্য নিজেকে সবার থেকে বড় মনে করা এবং ঔদ্ধত্য দেখানো। সচিব মহোদয়ার মতো চোখের পর্দাহীন উদ্ধত মানুষদের জন্য আমরা শুভ কামনা করি: তাঁরা যেন চোখের পর্দা ফিরে পান, তাঁরা যেন নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
তাঁদের এই রোগমুক্তির কাজে সহায়তার জন্য ট্রাফিক পুলিশের এই অভিযান নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাওয়া একান্ত কর্তব্য।